বাংলার ঐতিহ্য পাটভাঙা তাঁতের শাড়ি! জাতীয় তাঁত দিবসে ক্ষুদ্র এই কুটির শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখাই বড় চ্যালেঞ্জ

১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে কলকাতার টাউন হলে এই দিনেই স্বদেশী আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল, বিদেশি পণ্য বর্জন করে স্বদেশী পণ্য গ্রহন।

বাংলার ঐতিহ্য পাটভাঙা তাঁতের শাড়ি! জাতীয় তাঁত দিবসে ক্ষুদ্র এই কুটির শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখাই বড় চ্যালেঞ্জ

ট্রাইব টিভি ডিজিটাল: আজ জাতীয় তাঁত দিবস। প্রতি বছর ৭ অগাস্ট দেশজুড়ে পালিত হয় জাতীয় তাঁত দিবস। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে কলকাতার টাউন হলে এই দিনেই স্বদেশী আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল, বিদেশি পণ্য বর্জন করে স্বদেশী পণ্য গ্রহন। সেই দিবসের স্মরণে প্রতিবছর ৭ অগাস্ট জাতীয় হস্তচালিত তাঁত দিবস হিসেবে উদযাপিত হয়ে থাকে। 

জাতীয় হস্তচালিত তাঁত দিবসের মূল অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে ওড়িশার ভুবনেশ্বরে।
 দেশের হস্তচালিত তাঁত শিল্পকে তুলে ধরতে এবং তাঁতিদের সম্মানের উদ্দেশ্যেই ২০১৫ সালে কেন্দ্রীয় সরকার প্রতি বছর এই দিনটিকে জাতীয় হস্তচালিত তাঁত দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। বহু প্রাচীন গ্রন্থ, লেখনি কবিতা সাহিত্য থেকে জানা যায়, বাংলার তাঁতের সৃষ্টি নদীয়ার শান্তিপুর থেকে। শান্তিপুরের বস্ত্রশিল্প বিশেষত মসলিন অতীব প্রাচীন।
  মুঘল আমলে তা আরও বৃদ্ধি পায়। সে সময় দিল্লি থেকে এই বাংলার বস্ত্র পৌঁছতে ইরান তুরস্ক গ্রীস ইতালি কাবুল সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। 

মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের সময় ধুতি ও নকশার পাড় কাপড় জগত বিখ্যাত হয়। ইংরেজ আমল সূচনার আগে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পক্ষ থেকে শান্তিপুরে পাঁচ শতাধিক কর্মচারী বাস করত কুঠিরপাড়ায়, তাঁদের কাজ ছিল শান্তিপুর থেকে ছোট কারখানা "ঘাই"এবং বড় কারখানা "বানক"কে শান্তিপুরে তাঁত শিল্পীদের বোনা কাপড় সংগ্রহ এবং তা বিদেশে রফতানির ব্যবস্থা করা। সেই সূত্রে শানা বাঁধা, মাকু ,জোয়া ,ডাঙ্গি ,
নরদ, দক্তি ইত্যাদি নানান উপকরণ তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করতেন বহু পরিবার। বাড়ির মহিলারাও বসে থাকতেন না, তারা চরকায় সুতো কাটতেন। 
স্বদেশী আন্দোলনের সময় শান্তিপুরে প্রায় বারোশ তাঁত ছিলো বলেই জানা যায়। তবে স্বদেশী আন্দোলন বা আইন অমান্য আন্দোলন শান্তিপুরে তাঁতিদের ভূমিকা ছিল অগ্রণী। 

বিদ্যাসাগরের বিধবা বিবাহ আন্দোলন সমর্থন করে প্রচারের উদ্দেশ্যে শাড়ির পাড়ে নকশা ফুটিয়ে তুলেছিলেন, চন্দননগরের বৈদ্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের কবিতার লাইন, বিদ্যাসাগর চিরজীবী হয়ে /সদরে করেছে রিপোর্ট /বিধবা রমণীর বিয়ে।
 দীনবন্ধু মিত্রের লেখনী থেকে জানা যায়, নিবসতি করে লোক/ সংখ্যা নাহি তার/ গোঁসাই দর্জি তাঁতি হাজার হাজার।
নবীনচন্দ্র সেন লেখেন,  শান্তিপুরের ডূরে শাড়ি, শরমের অরি । এখন বিলেত যাত্রা করছে।
দ্বিজেন্দ্রলাল রায় গান লেখেন ওই পরনে তার ডুরে শাড়ি মিহী/শান্তিপুরে ওই/ শান্তিপুরে ডুরে  রে ভাই শান্তিপুরের ডূরে।
রসরাজ অমৃত লাল বসু তার রচনায় লেখেন ফুলপাড়ওয়ালা, নকশা পাড়, জমি জরিপাড় উরনি র কথা।

অনুরূপা দেবী লেখেন শান্তিপুরের ধুতির কথা। একসময় ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ঈশ্বরচন্দ্র ঘোষালের আদেশে তৈরি হয়েছিল কলাবতী পাড়ের কাপড়।
ঐতিহাসিক কালীপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন পৃথিবীর প্রায় সকল দেশের গল্প সাহিত্যে তাঁতিদের বোকা আখ্যায়িত করা হয়েছে। অথচ কিছুতেই বুঝতে পারছি না তুলা থেকে সুতা কেটে তা বয়ন করে কাপড়ে রূপান্তরিত করা ধৈর্যবান এবং সূক্ষ্ম শিল্প নৈপুণ্যতাযুক্ত তাঁতিরা কিভাবে বোকা হয়। 

বাংলার শিল্প বিভাগের পরিচালক ওয়েস্টন সাহেব শান্তিপুরের বস্ত্র বয়ন দেখে মুগ্ধ হয়ে, সর্বপ্রথম প্রায় ৭০০টি জ্যাকার্ড বয়ানের ব্যবস্থা করেন। তবে বিদেশি সুতোর আমদানি নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতার ফলে তাদের বাজার ভাটা দেখা দেয়, সে সময় প্রয়োজনে নিরিখে তৈরি হয় শ্রমিক সংঘ যার নেপথ্যে উঠে আসে কানাই পালের নাম।

কিশোরী লাল প্রামানিক বিখ্যাত কীর্তনীয়া ছিলেন। তার তৈরি তাঁতের শাড়ির পাড়ে নানা ভাষার নাম গান নজর কাটতো সকলে, রুমালে প্রতিকৃতি তৈরি করতে ওস্তাদ ছিলেন তিনি।
রামচন্দ্র দালাল 10 ঘন্টায় এক মোরা সুতো বয়ান করতে পারতেন এটাই ছিল তার কৃতিত্ব। নিতাই চাঁদ পার ও পাটা অতি দ্রুততার সাথে বুনতে ওস্তাদ ছিলেন। ১৮৮৫ সালে কলের সুতো আর ১৯২১ সালে বিলতি চিকন সুতোর বাজার রমরমা হতেই একটু একটু করে ভাটা পড়ে হস্ত চালিত তাঁত শিল্পে। মাঠা তাঁতের খটখট, জ্যাকার্ড তাঁতের ঝন ঝন, পাওয়ার লুমের গো গো, অবশেষে উন্নত নিঃশব্দ রেপিয়ার মেশিন সমস্ত শব্দ বন্ধ করে দিয়েছে। সেই সঙ্গে তাঁতিদের মুখের হাসিও। 

একসময়ের ৭০ শতাংশ তাঁতি আজ ২০ শতাংশে পরিণত হয়েছে। হস্তাচারিত তাঁত খুঁজে পাওয়া দূরহ। পদ্মশ্রী হোক বা রাজ্য-কেন্দ্রের সম্মান তা শুধুমাত্র মুষ্টিমেয় জনা কয়েকের জন্য। ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে তাঁত বুনে আসা, প্রবীন মানুষজন অন্য পেশায় যেতে পারেননি পূর্বপুরুষের কথা ভেবে। কারও আবার অন্য কোনও উপার্জনের উপায় জানা নেই।

 উন্নত মেশিনের ফলে, শতাধিক তাঁতের কাজ করে একটি মাত্র মেশিন তাও আবার ঘন্টা কয়েকের মধ্যেই। একদিকে কম দামে মানুষের চাহিদা মেটানো। অন্যদিকে, বিজ্ঞান প্রযুক্তির প্রভৃত উন্নতি সাধনের ফলে হস্ত চালিত তাঁত আজ লুপ্তপ্রায়। শান্তিপুরের প্রায় প্রত্যেকটি বাড়িতেই ৯-১০টি হস্ত চালিত তাঁত সম্বলিত কারখানা ঘর আজ বন্ধ, তালা মারা। কিভাবে চলছে তাঁতিদের জীবন ? করোনা পরিস্থিতিতেই বা তাদের কি সহযোগিতা করা হয়েছে সরকার থেকে? চলতি এক বছরে প্রায় দ্বিগুণ মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে সুতোর, বিপণনের সরকারি ব্যবস্থা থাকলেও তা কি আদৌ পৌঁছেছে তাঁত ঘরে? প্রতিবছর ঘটা করে পালিত হওয়া হস্ত চালিত তাঁত দিবসে উঠবে কি সেই প্রশ্ন?