ট্রাইব টিভি বাংলা ডিজিটাল: বুধবার চলতি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে তুলনায় শক্তিশালী ইংল্যান্ডকে হারিয়ে সব থেকে বড় চমক দিল আফগানিস্তান (Afghanistan beats England)। লাহোরে ইংরেজদের ৮ রানে হারিয়ে দিলেন ইব্রাহিম জাদরান, আজমাতুল্লাহ ওমারজাইরা। আফগানিস্তানের এই জয়ের ফলে জমে গেল চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির গ্রুপ ‘বি’ এর লড়াই। সেই সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার পর আফগানিস্তানের কাছে হেরে টুর্নামেন্ট থেকে বিদায় নিশ্চিত হয়ে গেল ইংল্যান্ডের। যা আয়োজক পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ করতে পারল না, চলতি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে সেটাই করে দেখালো আফগানিস্তান। জাদরানের ১৭৭ রানের অনবদ্য ইনিংস এবং বল হাতে ওমারজাইয়ের ৫ উইকেটই চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি থেকে ইংরেজদের বিদায় নিশ্চিত করে দিল। কাজে এলো না জো রুটের শতরানও।
আফগানিস্তানের এই জয়কে মোটেও অঘটন বলা যাবে না। কারণ দীর্ঘদিন ধরেই একদিনের ক্রিকেটে আফগানদের ধারাবাহিক সাফল্য কোনও মতেই অঘটন হতে পারে না (Afghanistan beats England)। সীমিত ওভারের ক্রিকেটে এখন আফগানিস্তান এখন সকলের সমীহ আদায় করে নিয়েছে। গোলাগুলি, ভূমিকম্পের সঙ্গে রাজনৈতিক বা আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি, প্রাকৃতিক প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে এবং মানবাধিকারের জন্য বা নারী স্বাধীনতার জন্য প্রতিমুহূর্তে লড়াই করা তালিবনের দেশে যে ক্রিকেট বেঁচে আছে তা গত কয়েক বছর ধরে প্রমাণ দিয়ে চলেছেন গুরবাজ, রশিদ খান, জাদরান, নবি, ওমারজাইরা।
আরও পড়ুন: Ibrahim Zadran: চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে ফের রেকর্ড, আফগানিস্তানের ইব্রাহিম জাদরানের দুরন্ত সেঞ্চুরি
ভারতের মাটিতে ২০২৩ আইসিসি বিশ্বকাপে ইংল্যান্ড, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে প্রথম ৬ দলের মধ্যে জায়গা করে নিয়েছিল আফগানিস্তান (Afghanistan beats England)। গত বছর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপেও গ্রুপ পর্বে নিউজিল্যান্ডকে এবং সুপার এইটে অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়েছিল আফগানরা। এবার চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতেও বুধবার লাহোরে ইংল্যান্ডকে হারিয়ে রশিদ খানরা বুঝিয়ে দিলেন তাঁরা আর বিশ্ব ক্রিকেটের ‘ছোট দল’ নন। তারা যেকোনো দলকে এখন হারানোর ক্ষমতা রাখে।
লাহোরের ‘ব্যাটিং প্যারাডাইস উইকেটে’ টসে জিতে প্রথমে ব্যাটিং নিতে বিন্দু মাত্র দ্বিধা করেননি আফগান অধিনায়ক হাসমাতুল্লাহ শাহিদী। কিন্তু শুরুতেই ইংলিশ পেসার জফ্রে আর্চারের ধাক্কায় ৩৭ রানের মধ্যেই ৩ উইকেট খুইয়ে বিপাকে পড়ে যায় আফগানিস্তান। ওপেনার রহমানুল্লাহ গুরবাজ (৬), সাদিকুল্লাহ অটল (৪) ও রহমত শাহ (৪) আর্চারের শিকার হয়ে ফিরে যান। লাহোরের গ্যালারিতে তখন ইংরেজ সমর্থকরা উচ্ছাস ও হাসি ঠাট্টায় মেতে উঠেছিলেন। কিন্তু তাদের সেই আনন্দ যে কিছুক্ষণের মধ্যেই নিরানন্দে পরিণত হতে চলেছে, তা গুনাহাক্ষরেও বুঝতে পারেননি তারা। সেখান থেকেই অধিনায়ক শাহিদীকে নিয়ে ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দেন জাদরান। আর তাতেই ঘুম উড়ে যায় ইংরেজদের (Afghanistan beats England)।

শাহিদী যখন এক দিক ধরে রাখলেন তখন উল্টোদিকে আক্রমণাত্মক ব্যাটিং করে গেলেন জাদরান। চতুর্থ উইকেটে দু’জনের ১০৩ রানের পার্টনারশিপ প্রাথমিক বিপর্যয় কাটিয়ে আফগানিস্তানকে ভালো জায়গায় দাঁড় করিয়ে দেয়। এই জুটি যখন ক্রমশই ভয়ংকর হয়ে উঠছিল তখনই ৩০তম ওভারের তৃতীয় বলে শাহিদীকে (৪০) ফিরিয়ে জুটি ভাঙেন ইংলিশ স্পিনার আদিল রশিদ। তখন আফগানিস্তানের রান ১৪০। কিন্তু তাতেও দমানো যায়নি জাদরান ও আফগানদের (Afghanistan beats England)। এরপর আজমাতুল্লাহ ওমারজাইকে নিয়ে রান এগিয়ে নিয়ে যান জাদরান। পঞ্চম উইকেটে তারা তোলেন ৮২ রান। ওভারটনের ৪০তম ওভারের শেষ বলে ৩১ বলে ৪১ রান করে বেন্টনের হাতে ক্যাচ দিয়ে ফেরেন ওমারজাই। ৪০ ওভারে ৫ উইকেটে তখন আফগানিস্তানের রান ২১২। এরপর আরও ভয়ংকর হয়ে ওঠেন জাদরান। আর তাঁকে যোগ্য সংগত করলেন মহম্মদ নবি।
তাঁদের সৌজন্যে শেষ ১০ ওভারে আফগানিস্তান তুলল ১১৩ রান। আর তাতেই তিনশো রানের গণ্ডি পেরিয়ে যায় আফগানিস্তানের। এদিন কোন ইংরেজ বোলারই জাদরানকে থামাতে পারেননি। ওপেন করতে নেমে পুরো ইনিংস জুড়েই ব্যাট করে শেষ পর্যন্ত ইংরেজ বোলারদের শাসন করে গেলেন। সেইসঙ্গে শতরান করে ম্যাচের সেরাও হলেন। তাঁর ১৪৬ বলে ১৭৭ রানের ইনিংসটি সাজানো ছিল এক ডজন বাউন্ডারি এবং ছয় ওভারবাউন্ডারিতে (Afghanistan beats England) । শেষে ৫০তম ওভারের প্রথম বলে তাকে ফেরান লিভিংস্টোন। নায়কোচিত ইনিংস খেলে আর্চারের হাতে জমা পড়েন। ২৪ বলে জোড়া বাউন্ডারি ও ৩ ওভার বাউন্ডারির সাহায্যে ঝোড়ো ৪০ রানের ইনিংস খেলে ৫০ ওভার শেষে আফগানিস্তানের রান ৭ উইকেটে ৩২৫ এ পৌঁছে দেন নবি। যদিও শেষ ওভারে তাঁকেও ফেরান লিভিংস্টোন। ইংল্যান্ডের হয়ে আর্চার তিনটি, লিভিংস্টোন দু’টি এবং ওভারটন ও রশিদ একটি করে উইকেট পেয়েছেন।
এদিন এই ইনিংস খেলে আফগানিস্তানের জয়ের রাস্তাই শুধু প্রশস্ত করলেন না, একাধিক রেকর্ডও গড়লেন আফগান ওপেনার ইব্রাহিম জাদরান। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ইতিহাসে তাঁর এই ১৭৭ রান কোনও ব্যাটসম্যানের ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ রান। গত শনিবার এই লাহোরের মাঠেই অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ইংল্যান্ডের বেন ডাকেটের করা ১৬৫ রানই ছিল চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত স্কোর। চার দিনের মধ্যেই সেই রেকর্ড ভেঙ্গে দিলেন আফগান ওপেনার। কোনও আফগান ক্রিকেটারেরও একদিনের ক্রিকেটে এটাই সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত রান। যদিও এদিন নিজেই নিজের এই রেকর্ড ভাঙলেন জাদরান (Afghanistan beats England)। এর আগে ২০২২ সালে পাল্লেকেলেতে শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে তাঁর ১৬২ রানের ইনিংসটাই ছিল কোনও আফগান ব্যাটসম্যানের সাদা বলের ক্রিকেটে সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত রান। তিনিই আফগানিস্তানের প্রথম ব্যাটসম্যান যিনি বিশ্বকাপে শতরান করেছেন। ২০২৩ বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ১২৯ রানে অপরাজিত ছিলেন। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতেও প্রথম আফগান ক্রিকেটার হিসেবে শতরানে করার নজির গড়লেন।

৩২৬ রান তাড়া করতে নেমে ৩০ রানের মধ্যেই ফিল সল্ট (১২) এবং জেমি স্মিথের (৯) উইকেট হারিয়ে রীতিমতো চাপে পড়ে যায় ইংল্যান্ড। সল্টকে ফেরান ওমারজাই এবং নবির শিকার হয়ে ফেরেন স্মিথ। এরপর ইংলিশ ইনিংসের হাল ধরেন ডাকেট এবং জো রুট। অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে দুরন্ত সেঞ্চুরি করা ডাকেট এদিনও ভালো ব্যাট করছিলেন। কিন্তু তাঁকে বিপজ্জনক হতে দেননি রশিদ খান। ৪৫ বলে ৩৮ রান করে রশিদের বলে এলবিডব্লিউ হয়ে ফেরেন তিনি। তবে উল্টোদিকে ইংল্যান্ডের জয়ের আশা বাঁচিয়ে রেখেছিলেন প্রাক্তন অধিনায়ক রুট (Afghanistan beats England)। কিন্তু জয় পাওয়ার জন্য যেটা সবথেকে বেশি প্রয়োজন ছিল, সেই প্রয়োজনীয় বড় পার্টনারশিপই করতে পারল না ইংল্যান্ড। হ্যারি ব্রুক (২১ বলে ২৫), জস বাটলার (৪২ বলে ৩৮), লিয়াম লিভিংস্টোনেরা (৮ বলে ১০) দ্রুত রান তোলার চেষ্টা করতে গিয়ে নবি, ওমারজাইদের শিকার হয়ে ফিরলেন।
আরও পড়ুন: Copa del Rey: কোপা দেল রে সেমিফাইনালের প্রথম লেগে বার্সেলোনা-অ্যাটলেটিকোর রোমাঞ্চকর ৪-৪ ড্র
শেষে রুট ও জেমি ওভারটন একটা মরিয়া চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু সেঞ্চুরি করেও দলের হার আটকাতে পারেননি রুট। ১১১ বলে ১১ বাউন্ডারি ও এক ওভার বাউন্ডারির সাহায্যে ১২০ রান করে ওমারজাইয়ের বলে গুরবাজের হাতে ক্যাচ দিয়ে রুট ফিরতেই ইংল্যান্ডের জয়ের আশা শেষ হয়ে যায়। (Afghanistan beats England) শেষে ওভারটনের ২৮ বলে ৩২ রান, আর্চারের ৮ বলে ১৪ রান এবং আদিল রশিদের ৫ রানও ইংল্যান্ডের হার বাঁচাতে পারেনি। ওভারটন ও আর্চারকে ফেরান ওমারজাই। আদিল রশিদকে ফেরান ফারুকি। ৪৯.৫ ওভারে জয় থেকে নয় রান দূরে ৩১৭ রানেই শেষ হয়ে যায় ইংল্যান্ডের ইনিংস। আফগানিস্তানের হয়ে ৫৮ রং দিয়ে পাঁচ উইকেট নিলেন ওমারজাই। দু’টি উইকেট মহম্মদ নবির। আর একটি করে উইকেট পেলেন রশিদ খান, ফারুকি ও গুলবাদিন নবি।
গ্রুপ ‘বি’ থেকে সেমিফাইনালে ওঠার জটিল অংক (Afghanistan beats England)
ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে এদিন আফগানিস্তানের এই জয়ের ফলে জমে গেল চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির গ্রুপ-‘বি’ থেকে সেমিফাইনালে ওঠার লড়াই। দুই ম্যাচে অস্ট্রেলিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকার পয়েন্ট ৩। দুই দলই একটি করে ম্যাচ জিতেছে। এবং গত মঙ্গলবার বৃষ্টির জন্য অস্ট্রেলিয়া বনাম দক্ষিণ আফ্রিকা ম্যাচ পরিত্যক্ত হওয়ায় পয়েন্ট ভাগাভাগির ফলে দুই দলই এক পয়েন্ট করে পেয়েছে। তাই দুই দলের পয়েন্ট এখন ৩। সেখানে দুই ম্যাচে একটি করে ম্যাচ জিতে ও পরাজিত হয়ে আফগানিস্তানের পয়েন্ট ২। দুই ম্যাচ হেরে ইংল্যান্ডের বিদায় নিশ্চিত হয়ে গেল (Afghanistan beats England)। ফলে এই গ্রুপ থেকে সেমিফাইনালে ওঠার লড়াই এখন অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা ও আফগানিস্তানের মধ্যে।
আগামী শুক্রবার এই লাহোরেই অস্ট্রেলিয়ার মুখোমুখি হবে আফগানিস্তান। এই ম্যাচটাও দুই দলের কাছেই গুরুত্বপূর্ণ। যদি শুক্রবার অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধেও জাদরানরা আবারও অঘটন ঘটায় তাহলে গ্রুপ ‘বি’ থেকে ৪ পয়েন্ট নিয়ে সেমিফাইনালে পৌঁছে যাবে আফগানিস্তান। আর অস্ট্রেলিয়া জিতলে তারা ৫ পয়েন্ট নিয়ে সেমিফাইনাল নিশ্চিত করবে। তবে আগামী ১ মার্চ করাচিতে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে ইংল্যান্ড শেষ ম্যাচ জিতলেও তারা কোনভাবেই পৌঁছতে পারবে না সেমিফাইনালে (Afghanistan beats England)। যদি শুক্রবার আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে অস্ট্রেলিয়া জেতে তাহলে দক্ষিণ আফ্রিকার সেমিফাইনালে যাওয়া আগেই নিশ্চিত হয়ে যাবে। কারণ তখন অস্ট্রেলিয়ার পয়েন্ট দাঁড়াবে ৫। আর দক্ষিণ আফ্রিকার পয়েন্ট হবে ৩। সেক্ষেত্রে ইংল্যান্ডের কাছে হারলেও দক্ষিণ আফ্রিকার সেমিফাইনালে ওঠা আটকাবে না। আর যদি উল্টোটা হয় অর্থাৎ আফগানিস্তান যদি অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে দেয় তাহলে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে মরণ-বাঁচন ম্যাচ হয়ে দাঁড়াবে দক্ষিণ আফ্রিকার।

শেষ চারে পৌঁছতে হলে তখন ইংল্যান্ডকে হারাতেই হবে দক্ষিণ আফ্রিকাকে। যদি আফগানিস্তান অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে দেয় এবং ইংল্যান্ডের কাছে যদি দক্ষিণ আফ্রিকা হেরে যায় সেক্ষেত্রে অস্ট্রেলিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকার পয়েন্ট সমান থাকায় রান রেটের বিচারে যে এগিয়ে থাকবে দ্বিতীয় দল হিসেবে সেই যাবে সেমিফাইনালে (Afghanistan beats England)। তখন গ্রুপ শীর্ষে থেকে সেমিফাইনালে পৌঁছবে আফগানিস্তান। আর আফগানিস্তান ও দক্ষিণ আফ্রিকা যদি তাদের শেষ ম্যাচ জেতে তাহলে ছিটকে যাবে অস্ট্রেলিয়া। তখন শীর্ষে থেকে দক্ষিণ আফ্রিকা ও দ্বিতীয় দল হিসেবে আফগানিস্তান পৌঁছে যাবে সেমিফাইনালে। তাই বুধবার জিতে গ্রুপ ‘বি’ এর লড়াই যে আফগানিস্তান জমিয়ে দিল, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।