ট্রাইব টিভি বাংলা ডিজিটাল: সারা বছর মনে পড়ে না। কিন্তু কালীপুজো (Kali Puja) এলেই শোনা যায় বুড়িমার নাম। বুড়িমার চকলেট (Burimar Chocolate)। তিনি সবার কাছেই বুড়িমা। বাচ্চাদের কাছেও বুড়িমা। আবার বড়দের কাছেও বুড়িমা। হাজারো আতশবাজির মাঝে আজও তার নামের বাজি রমরমিয়ে চলছে।
কিন্তু কে এই বুড়িমা? কেনই বা হঠাৎ করে চকলেটের সঙ্গে বুড়িমার নাম জুড়ল? তিনি কি তবে এই চকলেট তৈরি করেছিলেন? রয়েছে চোখের জল আনা ইতিহাস (History)। দেশভাগের তীব্র কষ্ট নিয়ে ওপার বাংলা থেকে এপার বাংলায় চলে এসেছিলেন এক মহিলা।
যে চকলেট ফাটিয়ে সবার মুখে হাসি ফুটে ওঠে, তার পিছনে রয়েছে সর্বস্বান্ত হয়ে যাওয়া এক পরিবারের কষ্টের গল্প। বুড়িমা (Burimar Chocolate) আদতে একজন মা, একজন স্ত্রী। যিনি নিজের সংসারকে বাঁচাবেন বলে কী না করেননি। অবশেষে হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন। শেষ বারের জন্য চেষ্টা করেন, বাজির ব্যবসা করবেন। আর তাতেই ভাগ্য ফিরে গেল। সামান্য চকলেট বাজি বুড়িমার ভাগ্য কীভাবে ফিরিয়ে ছিল? আজকের সেই গল্পই বলবো আপনাদের।
কে এই বুড়িমা? (Burimar Chocolate)
বুড়িমার আসল নাম অন্নপূর্ণা দাস। তিনি সাক্ষাৎ অন্নপূর্ণাই ছিলেন। তার মনের জোর, তার লড়াই করার সাহস, সবার মধ্যে নেই। এটা জোর গলায় বলতে পারি। বুড়িমা জন্মেছিলেন বর্তমান বাংলাদেশের (Bangladesh ) ফরিদপুর জেলায়। তারপর দেশভাগ হতেই, তিনি ছিন্নমূল হয়ে গেলেন। কালীপুজো এলে যার নাম মানুষের মুখে মুখে ঘোরে, সেই তিনি সব হারিয়ে একটা সময় এপার বাংলায় এলেন।। এখনো তার চকলেট বোম না হলে কালীপুজোটা যেন জমে না। যদিও এখন ডেসিবেল ধরে বাজির শব্দ মাপা হয়। তাই সেই যুগের বুড়িমার নাম কিছুটা মলিন। কিন্তু ইতিহাস কথা বলে, তিনি ফুরিয়ে যাননি।
শব্দের সাম্রাজ্য (Burimar Chocolate)
একটা সময় বুড়িমা, শব্দবাজির সাম্রাজ্য চালিয়েছেন। শুধু কালী পুজোয় নয়, যে কোনও উৎসব পার্বণে, বড় বড় সেলিব্রেশনে হত বুড়িমার গর্জন। নিজের ভিটে মাটি ছেড়ে চলে আসেন পশ্চিম দিনাজপুর জেলার ধলদিঘি সরকারি ক্যাম্পে। তারপর স্থায়ী ঠিকানা হয় হাওড়ার বেলুড়ে। তার মাঝে অনেকটা লম্বা লড়াইয়ের গল্প। গরিব ঘরের মেয়ে ছিলেন। জীবনের লড়াইয়ে হেরে যেতে শেখেননি। পরবর্তী জীবনে ধীরে ধীরে হয়ে উঠলেন সফল ব্যবসায়ী। সংসার চালাতে কী না করেননি? ধলদিঘির বাজারে রাস্তায় সবজি বিক্রি করতেন। শুধুমাত্র সন্তানের মুখে এক মুঠো অন্ন তুলে দেবেন বলে।
বিভিন্ন কাজে সংসার চালানোর চেষ্টা (Burimar Chocolate)
একটা সময় ধলদিঘী থেকে চলে যান গঙ্গারামপুর। সবজির ব্যবসা করলেও সংসার চলত না। কিছুদিন বিড়ি বাঁধার কাজ করলেন। নিজের বিড়ির ব্যবসা শুরু করলেন। তারপর বেলুড়ে প্যারীমোহন মুখার্জি স্ট্রিটে একটা দোকানসহ বাড়ি কিনে ফেললেন। বিড়ির সঙ্গে একে একে যুক্ত করলেন আলতা সিঁদুরের ব্যবসা । ছোটখাট ব্যবসা করতেন। লক্ষ্য ছিল, সংসারটাকে কিভাবে দাঁড় করাবেন। বিশ্বকর্মা পুজোয় ঘুড়ি, দোলে রং, তারপর কালীপুজোয় বাজি। একের পর এক ব্যবসায় লস খাচ্ছিলেন। অন্যের থেকে কিনে এনে বিক্রি ছিল বুড়িমার ব্যবসা। অবশেষে হাল ছেড়ে দেন। শেষ চেষ্টা করেন, বাজি ব্যবসায়। আর সেখানেই তিনি লাভ করতে শুরু করলেন। বুড়িমার মধ্যে সব সময় নতুন কিছু করার একটা তাগিদ থাকতো, যা হার মানিয়ে দেয় তরুণদের। দোকানে ক্রেতারা এসে অন্নপূর্ণা দেবীকে বুড়িমা বলে ডাকতেন। তারপর ধীরে ধীরে তিনি হয়ে গেলেন সবার বুড়িমা ।
বাজি বানিয়ে বিক্রি (Burimar Chocolate)
অন্নপূর্ণা দেবী লক্ষ্য করলেন, বাজি কিনে বিক্রি করেন করার থেকে, যদি বানিয়ে বিক্রি করেন, তাহলে লাভ অনেক বেশি। ব্যাস, শুরু করে দিলেন বাজি তৈরি করা। কারখানাও তৈরি করলেন। তার জন্য পোহাতে হলো হাজারো আইনি ঝামেলা। সে সমস্ত সামলে পেলেন লাইসেন্স। বিভিন্ন জায়গা থেকে নিজেই কারিগর খোঁজ করে নিয়ে আসতেন। তারপর নিজের নতুন নামে তৈরি করলেন ব্যান্ড। ধীরে ধীরে বাজির বাজারে ছেয়ে গেল বুড়িমা ব্যান্ডের বাজি। সবথেকে বেশি সেই সময় নাম করল, বুড়িমার চকলেট বোম।
বুড়িমার ছেলে (Burimar Chocolate)
১৯৯৫ সালের জুন মাসে বুড়িমায়ের মৃত্যুর পর, ব্যবসার হাল ধরেন তার পুত্র সুধীর কুমার দাস। এখনো রমরমিয়ে চলছে বুড়িমা ফায়ার ওয়ার্কস-এর কাজ। শব্দবাজি নিষিদ্ধ হয়ে যাওয়ার পরে, চকলেট বোমা এখানে তৈরি হয় না। তার বদলে নানান ধরনের আতশবাজি তৈরি হয়। তাতে কিন্তু বুড়িমার বাজির খ্যাতি এতটুকু ম্লান হয়নি। বহুদূরান্ত থেকে মানুষ বেলুড়ে যান বুড়িমার আতশবাজি কিনতে। তবে বেলুড়ের কারখানায় মূলত শব্দ দূষণ হয় না, এমন বাজি বানানো হয়। শব্দ দূষণের কারণে চকলেট বোমা প্রায় লুপ্ত। তবে বুড়িমা বেঁচে আছেন আমাদের সবার মাঝে, কিংবদন্তি হয়ে।