Last Updated on [modified_date_only] by Debu Das
ট্রাইব টিভি বাংলা ডিজিটাল : ভারতের দক্ষিণ প্রান্তের ঠিক ৯ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত গ্রেট নিকোবর (Greater Nicobar Project) দ্বীপে শুরু হতে চলেছে দেশের অন্যতম বৃহৎ অবকাঠামোগত বিনিয়োগ—৭২ হাজার কোটি টাকার গ্রেট নিকোবর প্রকল্প। কেন্দ্রের দাবি, এই প্রকল্প ভারতকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বাণিজ্য ও কৌশলগত মানচিত্রে নতুন উচ্চতায় পৌঁছে দেবে। তবে সমালোচকদের মতে, এটি এক “পরিকল্পিত বিপর্যয়”, যা দ্বীপের অনন্য জীববৈচিত্র্য, আদিবাসী সমাজ ও পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে উঠতে পারে। এই প্রতিবেদনে প্রকল্পটির বিস্তার, কৌশলগত তাৎপর্য, অর্থনৈতিক সম্ভাবনা, রাজনৈতিক বিতর্ক এবং পরিবেশ ও মানবিক সংকটকে বিশদভাবে আলোচনা করা হলো।
কী এই গ্রেট নিকোবর প্রকল্প? (Greater Nicobar Project)
২০২১ সালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির(Narendra Modi) মন্ত্রিসভা হোলিস্টিক ডেভেলপমেন্ট অব গ্রেট নিকোবর আইল্যান্ড নামে প্রকল্পটি অনুমোদন করে। আনুমানিক ৩০ বছরের মধ্যে ধাপে ধাপে এটি বাস্তবায়ন হবে(Greater Nicobar Project)।
প্রকল্পের মূল চারটি অংশ হলো:
- গালাথিয়া বে ট্রানশিপমেন্ট পোর্ট: বছরে প্রায় ১৪.৫ মিলিয়ন কন্টেইনার সামলানোর ক্ষমতা থাকবে। লক্ষ্য হলো সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ার মতো ট্রানশিপমেন্ট হাবের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করা।
- আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর: ৩৩০০ মিটার রানওয়ে সহ নতুন বিমানবন্দর, যা প্রশস্ত-বডি বিমান ওঠানামার উপযোগী। এতে দ্বীপে আন্তর্জাতিক যোগাযোগ বৃদ্ধি পাবে।
- বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র: ৪৫০ মেগাওয়াট গ্যাস-ভিত্তিক ও সোলার পাওয়ার প্ল্যান্ট, যা দ্বীপকে শক্তি-নির্ভরশীল করবে।
- নতুন টাউনশিপ: প্রায় ৬৫ হাজার মানুষের বসতি গড়ে তোলার পরিকল্পনা, যার মধ্যে শ্রমিক, কর্মকর্তা ও তাদের পরিবার অন্তর্ভুক্ত।
সরকারি অনুমান অনুযায়ী, ২০৪০ সালের মধ্যে এই প্রকল্প থেকে বছরে ৩০ হাজার কোটি টাকারও বেশি আয় হবে এবং ৫০ হাজার কর্মসংস্থান তৈরি হবে।
ভারতীয় নৌবাহিনীর নতুন ফ্রন্টলাইন (Greater Nicobar Project)
গ্রেট নিকোবর দ্বীপ ভারতের জন্য শুধু অর্থনৈতিক নয়, কৌশলগত দিক থেকেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ(Greater Nicobar Project)।
- মালাক্কা প্রণালীতে প্রভাব: বিশ্বের প্রায় ২৫ শতাংশ বাণিজ্য এবং ৮০ শতাংশ চীনা তেল আমদানি এই প্রণালী দিয়ে হয়। দ্বীপ থেকে মাত্র ৯০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই প্রণালীতে ভারতের উপস্থিতি শক্তিশালী হলে চীনের স্ট্রিং অফ পার্লস কৌশল কার্যত চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে।
- দ্রুত নৌ ও বিমান মোতায়েন: আন্দামান-নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ ভারতের নৌবাহিনীকে পূর্ব ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে দ্রুত মোতায়েনের সুযোগ দেয়। সাবমেরিন ও যুদ্ধজাহাজের কার্যক্ষমতা বাড়বে।
- পূর্ব উপকূলে ঘাঁটির ঘাটতি পূরণ: বিশাখাপত্তনম বন্দরে নৌবাহিনী ও বাণিজ্যিক জাহাজ একসঙ্গে ভিড়ায় চাপ তৈরি হচ্ছে। নিকোবর বন্দর এই চাপ কমাবে।
- আঞ্চলিক সহযোগিতা: ইতিমধ্যেই ভারত সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি দেশের সঙ্গে যৌথ টহল ও মহড়া করছে। নিকোবর ঘাঁটি হলে সহযোগিতা আরও দৃঢ় হবে।
প্রাক্তন নৌপ্রধান অ্যাডমিরাল করমবীর সিংহের ভাষায়, “আন্দামান-নিকোবর দ্বীপপুঞ্জকে আমরা অপারেশনাল টার্নঅ্যারাউন্ড বেসে পরিণত করার পরিকল্পনা বহুদিন ধরে করছি। গ্রেট নিকোবর এই পরিকল্পনার কেন্দ্রবিন্দু।”
অর্থনৈতিক সম্ভাবনা ও নতুন বাণিজ্যিক কেন্দ্র(Greater Nicobar Project)
গ্রেট নিকোবর প্রকল্পকে কেন্দ্র সরকার শুধু প্রতিরক্ষা নয়, অর্থনৈতিক উন্নয়নেরও মূল চালিকা হিসেবে দেখছে(Greater Nicobar Project)।
- ট্রানশিপমেন্ট ফি সাশ্রয় করে বছরে প্রায় ২০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বাঁচবে। বর্তমানে ভারতীয় কার্গো সিঙ্গাপুর, কলম্বো বা পোর্ট ক্ল্যাং হয়ে দেশে আসে।
- ২০৪০ সালের মধ্যে প্রকল্প থেকে ৩০ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আসতে পারে।
- ৫০ হাজার কর্মসংস্থান তৈরি হবে।
- সাগরমালা উদ্যোগের অংশ হিসেবে উপকূলীয় অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোকে উৎসাহিত করবে।
অর্থনীতিবিদদের মতে, এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে ভারত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বাণিজ্যে নতুন শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হবে।

জীববৈচিত্র্যের ধ্বংসের আশঙ্কা(Greater Nicobar Project)
তবে প্রকল্প ঘিরে সবচেয়ে বড় বিতর্ক পরিবেশগত ক্ষতি নিয়ে(Greater Nicobar Project)।
- ইউনেস্কো ঐতিহ্য সম্ভাব্য অঞ্চল: গ্রেট নিকোবর দ্বীপ এশিয়ার অন্যতম সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্যের কেন্দ্র। এখানে রয়েছে প্রায় ২০০ প্রজাতির পাখি, ৮৫ শতাংশ এলাকা জুড়ে অরণ্য এবং অসংখ্য বিরল প্রাণী।
- গালাথিয়া বে সংকটে: লেদারব্যাক কচ্ছপের অন্যতম বৃহৎ প্রজননক্ষেত্র এখানে অবস্থিত। এছাড়া ম্যানগ্রোভ ও প্রবালপ্রাচীর রয়েছে, যা সুনামির বিরুদ্ধে প্রাকৃতিক ঢাল হিসেবে কাজ করে।
- ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা: ২০০৪ সালের ভয়াবহ সুনামি এই দ্বীপকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল। নতুন প্রকল্প আরও ঝুঁকি বাড়াবে বলে সতর্ক করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
- দ্রেজিং ও নির্মাণ: কোটি কোটি ঘনমিটার সমুদ্রতল খুঁড়ে পোর্ট নির্মাণে প্রবালপ্রাচীর ধ্বংস ও ক্ষয় বাড়বে।
পরিবেশবিদ পঙ্কজ সেকসারিয়া বলেন, “গ্রেট নিকোবর প্রকল্প এশিয়ার অন্যতম সমৃদ্ধ ইকোসিস্টেম ধ্বংস করবে। এটি এক ‘গ্রেট নিকোবর বেট্রেয়াল’।’’
আরও পড়ুন : Uidai Aadhaar Card : ভোটার তালিকা সংশোধনে আধার কার্ডকে বৈধ নথি হিসেবে অন্তর্ভুক্তি
শম্পেন উপজাতির অস্তিত্বের সংকটে(Greater Nicobar Project)
প্রকল্পের কারণে সরাসরি প্রভাবিত হবে শম্পেন উপজাতি(Greater Nicobar Project)।
- মাত্র ৩০০–৪০০ জন সদস্যবিশিষ্ট এই উপজাতিকে বিশেষভাবে ঝুঁকিপূর্ণ উপজাতি গোষ্ঠী (PVTG) হিসেবে ঘোষণা করেছে সরকার।
- তাদের প্রধান জীবনধারা হলো শিকার ও বনজ সংগ্রহ। প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে প্রায় ১৩০ বর্গকিলোমিটার এলাকা থেকে তারা উচ্ছেদ হবে।
- বিশেষজ্ঞদের মতে, বাইরের সংস্পর্শে এলে তারা রোগ-ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে নিশ্চিহ্ন হওয়ার ঝুঁকিতে।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন সারভাইভাল ইন্টারন্যাশনালের কর্মকর্তা ক্যালাম রাসেল বলেন, “অস্পর্শ উপজাতিরা বাইরের সাধারণ রোগেও ব্যাপক হারে মারা যায়। গ্রেট নিকোবর প্রকল্প শম্পেনদের অস্তিত্বকেই হুমকির মুখে ফেলবে।”
আইনি ও প্রশাসনিক জটিলতা(Greater Nicobar Project)
প্রকল্পটি আইনি প্রশ্নেও জড়িয়েছে(Greater Nicobar Project)।
- পরিবেশ আইন অনুযায়ী কোস্টাল রেগুলেশন জোন-১এ এলাকায় বড় নির্মাণকাজ নিষিদ্ধ। কিন্তু গালাথিয়া বে সেই জোনের মধ্যেই পড়ছে।
- পরিবেশ মন্ত্রক থেকে দ্রুত ছাড়পত্র দেওয়ায় প্রশ্ন তুলেছেন বিশেষজ্ঞরা।
- কেন্দ্রীয় সরকারের সংস্থা এনআইআইডিসিও প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে, তবে অনেক নথি আংশিকভাবে গোপন রাখা হয়েছে বলে অভিযোগ।
কংগ্রেস বনাম বিজেপি রাজনৈতিক বিতর্ক (Greater Nicobar Project)
সম্প্রতি কংগ্রেস নেত্রী সোনিয়া গান্ধী এক প্রবন্ধে এই প্রকল্পকে “অর্ধসিদ্ধ, ভ্রান্ত ও পরিকল্পিত বিপর্যয়” আখ্যা দেন(Greater Nicobar Project)। তিনি সতর্ক করেন, এতে দ্বীপের পরিবেশ ও আদিবাসী সমাজ ধ্বংস হবে।
রাহুল ও প্রিয়াঙ্কা গান্ধীও এই বক্তব্যকে সমর্থন করেছেন।
বিজেপি পাল্টা সুরে কংগ্রেসকে অভিযুক্ত করে বলেছে, তারা ভারতের কৌশলগত স্বার্থকে খর্ব করতে চাইছে। বিজেপি মুখপাত্র অনিল কে অ্যান্টনি বলেন, “গ্রেট নিকোবর প্রকল্প ভারতের জন্য একটি কৌশলগত সম্পদ। বিরোধীরা দেশের প্রবৃদ্ধির বিরুদ্ধে কাজ করছে।”
বিশেষজ্ঞদের ভিন্নমত(Greater Nicobar Project)
বিতর্কে বিশেষজ্ঞদেরও মতভেদ রয়েছে।
- একদল পরিবেশবিদ মনে করছেন, দ্বীপের ভঙ্গুর পরিবেশ এই ধরনের বিশাল প্রকল্প সামলাতে পারবে না। তাদের মতে, বিকল্প পরিবেশবান্ধব মডেল ভাবতে হবে।
- অন্যদিকে কৌশলবিদ ও অর্থনীতিবিদদের একাংশ বলছেন, চীনকে প্রতিহত করতে এবং ভারতকে বৈশ্বিক বাণিজ্যে শক্তিশালী অবস্থানে আনতে এই প্রকল্প অপরিহার্য।
সমাপনী মন্তব্য(Greater Nicobar Project)
গ্রেট নিকোবর প্রকল্প ভারতকে একদিকে কৌশলগত শক্তি ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পথে এগিয়ে দিতে পারে, অন্যদিকে পরিবেশ ও মানবিক মূল্যবোধের চরম ক্ষতি ঘটাতে পারে(Greater Nicobar Project)। সরকার যদি প্রকল্পটিকে এগিয়ে নিতে চায়, তবে তা হতে হবে পরিবেশবান্ধব পরিকল্পনা, আদিবাসী অধিকার সংরক্ষণ এবং স্বচ্ছ আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। ভারতের ভবিষ্যৎ কৌশলগত স্বপ্ন ও প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষার লড়াই—এই দুইয়ের সংঘাতে দাঁড়িয়ে আজ গ্রেট নিকোবর দ্বীপ।