রিমিক মাঝি, কলকাতা: ২০১৭ সালের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে ফাইনালে ভারতকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল পাকিস্তান। আট বছর আগে ইংল্যান্ডের মাটিতে হারের সেই মধুর প্রতিশোধ রবিবার দুবাইয়ে নিল ভারত। শুধু তাই নয়, বদলার ম্যাচে একতরফা জয় তুলে নিয়ে প্রথম দল হিসেবে এবারের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির (ICC Champions Trophy 2025) সেমিফাইনালে পৌঁছে গেল রোহিত শর্মারা। প্রথম ম্যাচে নিউজিল্যান্ডের পর ভারতের কাছেও হেরে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি থেকেই ছিটকে গেল আয়োজক পাকিস্তান।
রবিবার দুবাই ইন্টারন্যাশনাল স্টেডিয়ামে পাকিস্তানকে ৪৫ বল বাকি থাকতেই ৬ উইকেটে হারালো ভারত। সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে দুরন্ত ক্যামব্যাক করে শুধু ভারতকে জয় এনে দেওয়াই নয়, এতদিন ধরে চলা ব্যাটে রান খরা কাটিয়ে সমালোচকদের যোগ্য জবাবও দিলেন বিরাট কোহলি। ওয়ানডে কেরিয়ারে ৫১তম সেঞ্চুরি করার পাশাপাশি ১৪ হাজার রানের ক্লাবেও নিজের নাম লিখিয়ে ফেললেন ৩৬ বছরের ‘কিং কোহলি’ (ICC Champions Trophy 2025)। সব সমালোচনায় জল ঢেলে এভাবেও যে ফিরে আসা যায়, তা আরও একবার প্রমাণ করলো বিরাটের ব্যাট। ম্যাচ জেতানো বাউন্ডারিতে ১১১ বলে সেঞ্চুরি করে আবারও বুঝিয়ে দিলেন- তিনি বড় মঞ্চেরই খিলাড়ি। ম্যাচের সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কারও উঠল তাঁর হাতেই। রোহিত শর্মাদের গ্রুপের শেষ ম্যাচ নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে। তার আগেই বাংলাদেশ ও পাকিস্তানকে হারিয়ে দুই জয় তুলে নিয়ে সেমিফাইনালে পৌঁছে গেল ভারত।
পাক-ব্যাটিং-এ টান টান উত্তেজনা (ICC Champions Trophy 2025)
মেগা সানডের হাইভোল্টেজ ম্যাচে দুবাইয়ের উইকেটের কথা ভেবে টসে জিতে প্রথমে ব্যাটিং নিতে দ্বিতীয়বার ভাবেননি পাকিস্তানের অধিনায়ক মহম্মদ রিজিওয়ান। দুই ভারতীয় পেসার মহম্মদ শামি ও হর্ষিত রানাকে শুরুতে সামলে দিলেও বেশিদূর এগোতে পারেননি দুই পাক ওপেনার বাবর আজম ও ইমাম-উল-হক। এদিনও ব্যর্থ বাবর। নবম ওভারে বল করতে এসে দ্বিতীয় বলেই বাবরকে (২৫) ফিরিয়ে পাক শিবিরে প্রথম ধাক্কাটা দেন হার্দিক পান্ডিয়া। খোঁচা দিয়ে কেএল রাহুলের হাতে জমা পড়েন বাবর। তখন পাকিস্তানের রান সবে ৪১। সেই ধাক্কা কাটিয়ে ওঠার আগে পরের ওভারেই রানআউট হয়ে পাকিস্তানের বিপদ বাড়ান ফকহর জামানের জায়গায় দলে আসা অপর ওপেনার ইমাম (১০)।
আরও পড়ুন: ICC Champions Trophy 2025: চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির আগে পাকিস্তানের সুর নরম, ভারতীয় মৎস্যজীবীদের মুক্তি!
১০ ওভারের দ্বিতীয় বলে কুলদীপ যাদবকে মিডঅনে বল ঠেলে ইমাম রান নিতে গেলে ডাইরেক্ট থ্রোয়ে উইকেট ভেঙে দেন অক্ষর প্যাটেল। ৪৭ রানে ২ উইকেট খুইয়ে চাপে পড়ে যায় পাকিস্তান (ICC Champions Trophy 2025)। তবে জোড়া ধাক্কা দারুন ভাবে সামলে দেন অধিনায়ক মহম্মদ রিজওয়ান ও সাউদ সাকিল। তৃতীয় উইকেটে ১০৪ রানের পার্টনারশিপ করেন দু’জনে। এই জুটি যখন ক্রমশই জেঁকে বসেছিল তখনই ৩৪তম ওভারের দ্বিতীয় বলে রিজওয়ানকে বোল্ড করে গুরুত্বপূর্ণ ব্রেক থ্রু-টা দেন অক্ষর প্যাটেল।

তখন পাকিস্তানের রান ১৫১। যদিও তার আগের ওভারের শেষ বলেই হর্ষিত রানা যদি ক্যাচটা না ফেলতেন তাহলে হার্দিকেরই শিকার হতেন রিজওয়ান। ৭৭ বলে ৪৬ রান করে ফেরেন পাক অধিনায়ক। অক্ষরের ওই ওভারের পঞ্চম বলে সাকিলও আউট হয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু লং অনে সাকিলের ক্যাচ ফেলেন কুলদীপ। যদিও জুটি ভাঙার পর উইকেটে বেশিক্ষণ টিকতে পারেননি সাকিল। পরের ওভারেই ১৫৯ রানের মাথায় সাকিলকে ফিরিয়ে দেন হার্দিক। তবে ডিপ মিড উইকেটে অক্ষরের হাতে ধরা পড়ার আগে নিজের অর্ধশতরান পূর্ণ করেন সাকিল। ৭৬ বলে ৬২ রান করে ফেরেন তিনি। সেখানেই পাকিস্তানের সমস্ত জারিজুরি শেষ হয়ে যায়।
আরও পড়ুন: Kerala in Ranji Final: ঐতিহাসিক জয়! রঞ্জি ট্রফির ফাইনালে কেরালা
এরপর জাদেজা, কুলদীপ, হর্ষিত মিলে দ্রুত পাকিস্তানকে শেষ করে দেন। সলমন আঘা (১৯) ও সাহিন শাহ আফ্রিদি (০), নাসিম শাহকে (১৪) ফিরিয়ে দেন কুলদীপ। তায়েব তাহিরকে (৪) ফেরান জাদেজা। ৮ রান করে রান আউট হন হ্যারিস রউফ। উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে সতীর্থদের প্যাভেলিয়েনে ফেরার শোভাযাত্রা দেখছিলেন অসহায় খুশদিল শাহ (ICC Champions Trophy 2025)। শেষে ৩৯ বলে জোড়া ছক্কার সাহায্যে ৩৮ রান করে হর্ষিতের শিকার হন খুশদিল। আর তাতেই ৪৯.৪ ওভারে ২৪১ রানেই শেষ হয়ে যায় পাকিস্তানের ইনিংস।শেষবেলায় শামি এক ওভারে দু’টি ছক্কা না খেলে আরও কম রানেই শেষ হয়ে যেত পাকিস্তান।
ভারতীয় বোলিং লাইনআপের চাপে পাক-ব্যাটাররা (ICC Champions Trophy 2025)
এদিন ম্যাচের প্রথম বল থেকেই পাকিস্তানি ব্যাটারদের চাপে রাখলেন ভারতীয় বোলিং লাইনআপ। গত বাংলাদেশ ম্যাচে ৫ উইকেট পাওয়া মহম্মদ শামি এই ম্যাচে ছন্দে ছিলেন না। ৮ ওভার বল করে ৪৩ রান দিয়ে উইকেটহীন থেকে গেলেন। প্রথম ওভারে পাঁচটি ওয়াইড বল করেন। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে এটাই কোনও ভারতীয় বোলারের করা সবচেয়ে লম্বা ওভার। এর আগে কোনও বোলার এই টুর্নামেন্টে এক ওভারে ১১টি বল করেননি। (ICC Champions Trophy 2025) ২০১৭ সালে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ফাইনালে পাকিস্তানের বিরুদ্ধেই একটি ওভারে সর্বাধিক ৯ বল করেছিলেন জসপ্রীত বুমরাহ। এতদিন সেটিই ছিল সবচেয়ে দীর্ঘতম ওভার। শামি তাঁর থেকে আরও দু’টি বল বেশি করে সেই রেকর্ড ভেঙে দিলেন। তবে ৮ ওভারে ৩১ রান দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ২ উইকেট তুলে সেই জায়গাটা পূরণ করে দিলেন হার্দিক পান্ডিয়া।

অপর পেসার হর্ষিত ৭.৪ ওভারে ৩০ দিয়ে পেলেন একটি উইকেট। তবে এদিন তিন স্পিনরাই সফল। বাংলাদেশ ম্যাচে দুরন্ত বোলিং করেছিলেন পেসাররা। এদিন পাকিস্তানকে অল্পরানে বাঁধলেন স্পিনাররা। কুলদীপ, অক্ষর ও জাদেজা- তিন জনেই উইকেট পেলেন (ICC Champions Trophy 2025)। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সর্বদা সফল কুলদীপ যাদব এদিনও ৯ ওভারে ৪০ রান দিয়ে নিলেন ৩ উইকেট। অক্ষর প্যাটেল ও রবীন্দ্র জাদেজার শিকার একটি করে উইকেট। এদিন যেমন ধারাবাহিক ভাবে উইকেট পড়ল, তেমনই স্কোরবোর্ডে দ্রুত রান তোলা আটকে দিয়ে পাকিস্তানকে প্রথম থেকেই নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখল ভারতীয় বোলাররা।
৬ উইকেটে জয় (ICC Champions Trophy 2025)
রান তাড়া করতে নেমে শুরুতেই রোহিত শর্মার উইকেট হারায় ভারত। আফ্রিদির অসাধারণ ইয়র্কারে বোল্ড হন ভারত অধিনায়ক। রোহিতের কিছুই করার ছিল না। তবে ১৫ বলে ২০ রান করে শুরুতেই পাকিস্তানের উপর আরও চাপ তৈরি করে দিয়ে যান রোহিত। এরপর শুভমন গিলকে নিয়ে ঠান্ডা মাথায় দলকে জয়ের পথে এগিয়ে নিয়ে যান বিরাট কোহলি। দ্বিতীয় উইকেটে দু’জনের জুটিতে ওঠে ৬৯ রান। দলের রান যখন ১০০, তখন ১৮ ওভারের তৃতীয় বলে হাফ সেঞ্চুরির দোরগোড়া থেকে গিলকে ফেরান বাবর আহমেদ।
গত ম্যাচে সেঞ্চুরি করা গিল এদিন ৫২ বলে ৭ বাউন্ডারির সাহায্যে করলেন ৪৬ রান। এরপর শ্রেয়স আইয়ারকে নিয়ে দলকে সেমিফাইনালে তোলার দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেন বিরাট। (ICC Champions Trophy 2025) তৃতীয় উইকেটে তাঁদের ১১৪ রানের পার্টনারশিপই ভারতের জয় নিশ্চিত করে দেয়। যখন মনে হচ্ছিল এই জুটিই জিতিয়ে মাঠ ছাড়বে, তখনই ৩৯ ওভারের পঞ্চম বলে শ্রেয়সকে ফেরান খুশদিল। যদিও তার আগে নিজের হাফসেঞ্চুরি সেরে ফেলেন তিনি। ৬৭ বলে ৫ বাউন্ডারি ও এক ওভার বাউন্ডারির সাহায্যে ৫৬ রান করে ইমাম-উল-হকের হাতে ধরা পড়েন শ্রেয়স।
বিরাটের শতরানে হার পাকিস্তানের
ভারত তো বটেই গোটা বিশ্বের ক্রিকেট ভক্তরা মুখিয়ে ছিলেন বিরাটে রানে ফেরার অপেক্ষায়। অবশেষে সেই অপেক্ষার অবসান ঘটালেন কিং কোহলি। ঠান্ডা মাথায় ব্যাট করে একদিনের ক্রিকেটে নিজের ৫১তম সেঞ্চুরি করে দুরন্ত কামব্যাক করলেন (ICC Champions Trophy 2025)। কেরিয়ারে এটি তাঁর ৮২তম শতরান। এদিন সেইসঙ্গে ওয়ানডে কেরিয়ারে বিশ্বের তৃতীয় ব্যাটসম্যান হিসেবে ১৪ হাজার রান করার রেকর্ডও গড়লেন। ২৯৯ ম্যাচে। শুধু তাই নয়, দ্রুততম ব্যাটার হিসাবে এই বিশ্বরেকর্ড গড়লেন। এক দিনের ক্রিকেটে শচীন তেন্ডুলকরের রেকর্ড ভেঙে দিলেন। শচীন ১৪ হাজার রান করতে ৩৫০টি ইনিংস খেলেছিলেন। সেখানে কোহলি করলেন ২৮৭ ইনিংসে।

অর্থাৎ, শচীনের থেকে ৬৩ ইনিংস কম খেলে ১৪ হাজার রান করলেন বিরাট। তিন নম্বরে রয়েছেন শ্রীলঙ্কার কুমার সঙ্গকারা। ৩৭৮ ইনিংসে এই মাইলফলকে পৌঁছেছিলেন শ্রীলঙ্কার কিংবদন্তি উইকেট কিপার ব্যাটসম্যান। একদিনের ক্রিকেটে সর্বাধিক রানের তালিকাতে এখন বিরাটের সামনে শুধু শচীন এবং সাঙ্গাকারা। শচীনও ১৪ হাজার রান পূর্ণ করেছিলেন পেশোয়ারে পাকিস্তানের বিরুদ্ধেই। রবিবার পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ব্যাট করতে নামার আগে কোহলির রান ছিল ১৩,৯৮৫। ১৪ হাজার রান করতে এদিন মাত্র ১৫ রান করতে হত তাঁকে। ১৩তম ওভারের দ্বিতীয় বলে হ্যারিস রউফকে চার মেরে ১৪ হাজার রান পূর্ণ করলেন বিরাট।
ওভালের বদলা দুবাইয়ে! (ICC Champions Trophy 2025)
পাকিস্তানের বিরুদ্ধে তিনি যে বরাবরই জ্বলে ওঠেন, তা আবার প্রমাণিত হল (ICC Champions Trophy 2025) । কামব্যাকের জন্য আবার সেই পাকিস্তানকেই বেছে নিলেন। খুশদিলকে বাউন্ডারিতে পাঠিয়েই এদিন শতরান করলেন এবং তাতেই জিতল ভারত। ১১১ বলে ৭ বাউন্ডারির সাহায্যে ১০০ রানে অপরাজিত থেকে মাঠ ছাড়লেন। দুবাইয়ের মন্থর উইকেটে বল থেমে থেমে ব্যাটে আসছিল। তাই কোনও তাড়াহুড়ো না করে ঠান্ডা মাথায় যতবেশি সম্ভব সিঙ্গলসে জোর দিয়ে জয় এনে দিলেন বিরাট। শেষের দিকে হার্দিক পান্ডিয়াকে (৮) আফ্রিদি ফিরিয়ে দিলেও, তার প্রভাব পড়েনি। দলকে সেমিফাইনালে তুলেই মাঠ ছাড়লেন বিরাট। তাঁর সঙ্গে ৩ রান করে অপরাজিত থেকে যান অক্ষর। ৪৫ বল বাকি থাকতে ৪২.৩ ওভারেই ৪ উইকেট খুইয়ে জয় তুলে নেয় ভারত।