ট্রাইব টিভি বাংলা ডিজিটাল: ভারতের ব্যাঙ্কিং শিল্প বর্তমানে এক গভীর সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে (Indian Banks Deposit Crunch)। যেখানে ব্যাঙ্কের মূল কাজ অর্থ ঋণ দিয়ে লাভ করা, সেখানে আজ অনেক ব্যাঙ্ক ঋণ দিয়ে লোকসানের মুখোমুখি হচ্ছে। সম্প্রতি কোটাক মাহিন্দ্রা ব্যাঙ্কের প্রতিষ্ঠাতা উদয় কোটাকের এক চাঞ্চল্যকর মন্তব্য এই সঙ্কটকে কেন্দ্রবিন্দুতে এনে ফেলেছে। তাঁর মতে, ভারতের সরকারি ও বেসরকারি ব্যাঙ্কগুলি প্রত্যেকটি ঋণের পিছনে গড়ে ০.৫ শতাংশ করে ক্ষতির মুখ দেখছে। এই বক্তব্য দেশের আর্থিক ব্যবস্থার স্থিতিশীলতা নিয়ে এক বড় প্রশ্ন তুলে দিয়েছে।
মূলধন সংগ্রহের উৎস (Indian Banks Deposit Crunch)
ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থায় মূলধন সংগ্রহের অন্যতম উৎস হল আমানত (Indian Banks Deposit Crunch)। কিন্তু বর্তমানে ভারতীয় ব্যাঙ্কগুলি আমানত ঘাটতির সমস্যায় ভুগছে। সাধারণ মানুষের আমানতের পরিমাণ ক্রমেই কমছে। তার বদলে মিউচুয়াল ফান্ড, স্টক মার্কেটের মতো উচ্চ ঝুঁকির কিন্তু উচ্চ লাভের ক্ষেত্রগুলিতে বিনিয়োগের প্রবণতা বাড়ছে। এর ফলে ব্যাঙ্কগুলি আমানত ধরে রাখতে বাধ্য হচ্ছে উচ্চ সুদে হোলসেল ডিপোজিট গ্রহণ করতে, যার জন্য দিতে হচ্ছে প্রায় ৮ শতাংশ সুদ। এরই সঙ্গে ব্যাঙ্কের মার্জিনাল ডিপোজিট কস্ট বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৯ শতাংশে।
রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার নিয়মাবলি (Indian Banks Deposit Crunch)
ব্যাঙ্কগুলির আয় বা লাভের পথে আরও একটি বড় বাধা হল রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার নিয়মাবলি (Indian Banks Deposit Crunch)। প্রতি ব্যাঙ্ককে তার মোট আমানতের নির্দিষ্ট একটি অংশ রাখতে হয় RBI (Reserve Bank Of India) -তে, যার উপর কোনো সুদ পাওয়া যায় না। এর সঙ্গে রয়েছে স্ট্যাটুটরি লিকুইডিটি রেশিও (SLR), যেখানে ব্যাঙ্কগুলিকে বাধ্যতামূলকভাবে বিনিয়োগ করতে হয় সরকারি বন্ডে। এই খাতে সুদের হার এতটাই কম যে, কার্যত একে খরচের খাতায় ফেলতে হয়। ফলে ব্যাঙ্কের মোট মূলধনের একটি বড় অংশ থেকে কোনও লাভই আসছে না।

আরও পড়ুন: US Tariff War : শুল্ক নিয়ে ট্রাম্পের সঙ্গে কথা বলছে ৫০টি দেশ! ভারত এগোচ্ছে কোন পথে?
বিমার সুবিধা (Indian Banks Deposit Crunch)
এর পাশাপাশি সামাজিক দায়বদ্ধতা পূরণের জন্য ব্যাঙ্কগুলিকে (Indian Banks Deposit Crunch) দিতে হয় বিমার সুবিধা, যার প্রিমিয়ামও ব্যাঙ্ককেই বহন করতে হয়। ছোট ব্যবসা, কৃষিঋণ বা স্বনিযুক্ত শ্রেণিকে দেওয়া ঋণ থেকে ব্যাঙ্ক খুব সামান্যই সুদ আদায় করতে পারে। ফলে ব্যাঙ্কগুলির ব্যয় বাড়ছে, অথচ আয়ের উৎস কমছে।এই পরিস্থিতিতে ব্যাঙ্কগুলির একটি সহজ সমাধান হতে পারত ঋণের সুদের হার বৃদ্ধি করা। কিন্তু সেখানেও বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে RBI-এর রেপো রেট হ্রাসের নীতি। ফেব্রুয়ারিতে রেপো রেট ৬.২৫ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে, ফলে কম সুদে গৃহঋণ, গাড়ির ঋণ দিচ্ছে ব্যাঙ্কগুলি। ফলে মাসিক কিস্তি কমলেও ব্যাঙ্কের মুনাফা কমছে।

আরও পড়ুন: Protest Against Trump : ট্রাম্পের খামখেয়ালি সিদ্ধান্তে বিক্ষোভে নামছেন মার্কিন জনতা!
বিশ্লেষকদের পরামর্শ (Indian Banks Deposit Crunch)
এদিকে সরকারের তরফ থেকেও ব্যাঙ্কগুলিকে চাপ দেওয়া হচ্ছে যাতে সাধারণ মানুষকে আরও বেশি করে ঋণ দেওয়া হয় (Indian Banks Deposit Crunch)। এতে ব্যাঙ্কগুলির মধ্যে প্রতিযোগিতা বাড়ছে, এবং তারা কম সুদে ঋণ দিতে বাধ্য হচ্ছে, যা আরও লোকসানের দিকে ঠেলছে।এই সংকট থেকে বেরিয়ে আসার জন্য আর্থিক বিশ্লেষকরা একাধিক পরামর্শ দিয়েছেন। প্রথমত, ঋণের ক্ষেত্র বৈচিত্র আনতে হবে। শুধুমাত্র গৃহঋণের উপর নির্ভর না করে, কৃষি, ব্যবসা ও শিক্ষা ঋণের দিকে নজর দিতে হবে। দ্বিতীয়ত, অনুৎপাদক সম্পদ (NPA) বা ব্যর্থ ঋণ আদায়ে আরও কঠোর হওয়া জরুরি। তৃতীয়ত, দৈনন্দিন কার্যপ্রণালীর খরচ কমিয়ে ব্যাঙ্কের পরিচালন ব্যয় হ্রাস করতে হবে।
ব্যাঙ্কবান্ধব নীতি (Indian Banks Deposit Crunch)
তবে এর পাশাপাশি RBI এবং সরকারের পক্ষ থেকেও প্রয়োজন ব্যাঙ্কবান্ধব নীতি। সামাজিক প্রকল্পের খরচ পুরোপুরি ব্যাঙ্কগুলির উপর চাপিয়ে দিলে তাদের আর্থিক স্বাস্থ্যের অবনতি হবেই। রেপো রেট কমানোর ফলে দেশে মুদ্রাস্ফীতি সামাল দেওয়া গেলেও, ব্যাঙ্কগুলির লাভের পথ রুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে।এই প্রেক্ষাপটে, আগামী দিনে RBI-এর নীতিগত সিদ্ধান্ত, বিশেষ করে এপ্রিলের মুদ্রানীতি বৈঠক, অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হতে চলেছে। রিপোর্ট অনুযায়ী, RBI রেপো রেট আরও ২৫ বেসিস পয়েন্ট কমাতে পারে, যা ব্যাঙ্কগুলির জন্য আরেক দফা ধাক্কা হয়ে দাঁড়াতে পারে।
টিকে থাকার লড়াই (Indian Banks Deposit Crunch)
সব মিলিয়ে, ভারতের ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থা (Indian Banks Deposit Crunch) আজ এক ত্রিশঙ্কু অবস্থায় দাঁড়িয়ে রয়েছে—যেখানে লাভের আশা নয়, টিকে থাকাটাই এখন মূল লড়াই। এই সঙ্কট কাটিয়ে উঠতে প্রয়োজন যৌথ প্রচেষ্টা—ব্যাঙ্ক, সরকার ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার মধ্যে সমন্বয় ছাড়া এই সংকট থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব নয়।