ট্রাইব টিভি বাংলা ডিজিটাল: শিল্পপতি গৌতম আদানিকে নিয়ে উত্তাল গোটা দেশ। শেয়ার দরে কারচুপি ও জালিয়াতির অভিযোগ বিশ্বের প্রথম সারির এই শিল্পপতির বিরুদ্ধে। আমেরিকায় ভারতীয় শিল্পপতি গৌতম আদানির বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ। বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে প্রতারণার অভিযোগ গৌতম আদানির বিরুদ্ধে। ভারতে সৌরশক্তি প্রজেক্টের জন্য আধিকারিকদের ঘুষ অফার করার অভিযোগ।
বিতর্কের জেরে শেয়ারবাজারে আদানি শিল্পগোষ্ঠীর শেয়ারমূল্য নিম্নমুখী। গোটা ঘটনায় জেপিসি তদন্তর দাবি কংগ্রেসের। গতবছরই (২০২৩) মার্কিন সংস্থা হিন্ডেনবার্গ রিসার্চের অভিযোগে উত্তাল হয়ে ওঠে গোটা বিশ্ব। সেই অভিযোগের বছর না ঘুরতেই ফের নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়ে সংবাদ শিরোণামে শিল্পপতি গৌতম আদানি। যার আঁচ গিয়ে পড়েছে দেশের রাজনীতিতে। কে এই গৌতম আদানি। তাঁর বর্তমান সম্পত্তির পরিমাণই বা কত? তাঁর বিরুদ্ধে কী অভিযোগ এনেছে মার্কিন আদালত?
ভারতের সরকারি আধিকারিকদের ২৬.৫ কোটি ডলারের ঘুষের প্রস্তাব দেওয়া অভিযোগ উঠেছে আদানির বিরুদ্ধে। এই আবহে মার্কিন মুলুকে একটি মামলায় ভাইপো সাগর সহ অভিযুক্ত হয়েছেন ধনকুবের গৌতম আদানি এবং বেশ কয়েকজন ভারতীয় ব্যবসায়ী। রিপোর্ট অনুযায়ী, মার্কিন বিনিয়োগকারীদের প্রতারণা এবং কর্মকর্তাদের ঘুষের প্রস্তাব দেওয়ার অভিযোগ এনে আদানি গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান গৌতম আদানির বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছে মার্কিন বিচার বিভাগ এবং মার্কিন সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন। জানা গিয়েছে এই মামলায় গৌতম আদানির পাশাপাশি সাগর আদানি, আদানি গ্রিন এনার্জি লিমিটেডের নির্বাহী এবং আজিউর পাওয়ার গ্লোবাল লিমিটেডের নির্বাহী সিরিল কাবানেসকেও অভিযুক্ত করা হয়েছে। যদিও এই সব অভিযোগকে ভিত্তিহীন বলে দাবি করেছে আদানি গোষ্ঠী।
কে এই গৌতম আদানি? তাঁর উত্থান কী ভাবে!
বর্তমানে দেশের অন্যতম ধনীতম ব্যক্তি গৌতম আদানি। আদানি গোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠাতা গুজরাতি এই ব্যবসায়ীর উত্থান কিন্তু সিনেমার গল্পের থেকে কম চমকপ্রদ নয়। গুজরাতের আহমেদাবাদের এক জৈন পরিবারে ১৯৬২ সালের ২৪ জুন জন্ম গৌতম আদানির। বাবা শান্তিলাল ছিলেন বস্ত্র ব্যবসায়ী। মায়ের নাম শান্তি আদানি। গৌতমরা ৭ ভাইবোন। গৌতম আদানি পেশায় দন্ত্য চিকিৎসক প্রীতি আদানিকে বিয়ে করেন। এই দম্পতির দুই ছেলে- করণ আদানি এবং জিৎ আদানি। গৌতমের পড়াশোনাও ছিল সীমিত। কখনও কলেজের গণ্ডি তিনি পার করেননি। স্কুলও পাশ করেছিলেন কোনও মতে। গুজরাত বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক স্তরে ভর্তি হলেও পাশ করতে পারেননি। মাঝপথেই কলেজ ছেড়ে মুম্বইয়ে চলে আসেন গৌতম। মহেন্দ্র ব্রাদার্স নামে এক সংস্থার হীরে নির্বাচকের কাজে যোগ দিয়ে কৈশোর বয়সে ১৯৭৮ সালে মুম্বই যাত্রা গৌতম আদানির। তিনি মুম্বইয়ের জাভেরি বাজারে নিজস্ব হীরে দালালি সংস্থা প্রতিষ্ঠার আগে সেখানে ২-৩ বছর কাজ করেন। এরপর বড় ভাই মনসুখ ভাই আদানি ১৯৮১ সালে আহমেদাবাদে একটি প্লাস্টিক ইউনিট পলিভিনাইল ক্লোরাইড (পিভিসি) ক্রয় করেন এবং গৌতমকে তা পরিচালনার দায়িত্ব দেন।
১৯৮৫ সালে ক্ষুদ্র শিল্পের জন্য ‘প্রাইমারি পলিমার’-এর আমদানি শুরু করেন গৌতম। তার উপর ভিত্তি করেই ১৯৮৮ সালে গড়ে ওঠে ‘আদানি এক্সপোর্ট লিমিটেড’। যা বর্তমানে আদানি এন্টারপ্রাইজ নামে পরিচিত। তারপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি গুজরাতি এই শিল্পপতিকে। এরপর উল্কা গতিতে তাঁর উত্থান। পণ্য ব্যবসায়ী হিসাবে জীবন শুরু করা গৌতম আদানি এখন শক্তি, সংস্থান, বন্দর, রসদ, কৃষিক্ষেত্র, রিয়েল এস্টেট, আর্থিক পরিষেবা, গ্যাস, প্রতিরক্ষা ব্যবসা, বিমানবন্দর ও অন্যান্য অনেকগুলি ব্যবসার মালিক। এশিয়ার দ্বিতীয় ধনী ব্যক্তির সম্মানও পান ৬০ বছর বয়সী এই গুজরাতি শিল্পপতি। একাধিক বার মৃত্যুর মুখোমুখিও হয়েছেন গৌতম। ২০০৮ সালের ২৬ নভেম্বর মুম্বইয়ের তাজ হোটেলে সন্ত্রাসবাদী হামলার সময় তিনি ওই হোটেলেই ছিলেন। তখন তিনি নৈশভোজে ব্যস্ত। সন্ত্রাসবাদীদের গুলি থেকে প্রাণ বাঁচাতে হোটেলের বেসমেন্টে লুকিয়ে ছিলেন। চোখের সামনে খুন হতেও দেখেন একাধিক মানুষকে। ভারতীয় কম্যান্ডো হোটেলের বেসমেন্ট থেকে গৌতমকে উদ্ধার করেছিলেন। ১৯৯৭ সালে গৌতমকে অপহরণ করা হয়েছিল। মুক্তিপণ হিসাবে প্রায় ১৫ কোটি টাকা দাবি করেন অপহরণকারীরা। এই ঘটনায় পরে ৮ অভিযুক্তকে গ্রেফতার করেছিল পুলিশ।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে গৌতম আদানির ঘনিষ্ঠতার অভিযোগ তুলেছে বিরোধী দলগুলো। শিল্পপতি গৌতম আদানির সংস্থার আর্থিক বিবৃতি খতিয়ে দেখার কাজ শুরু করেছে কেন্দ্রীয় কর্পোরেট বিষয়ক মন্ত্রক। গত কয়েক বছরে আদানি গোষ্ঠীর যাবতীয় আর্থিক বিবৃতি এবং অন্যান্য ব্যবসায়িক লেনদেনের হিসেব পরীক্ষা করছেন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রকের দায়িত্বপ্রাপ্তরা। গত বুধবার হিমাচল প্রদেশে আদানি গোষ্ঠীর মালিকানাধীন সংস্থা আদানি উইলমার লিমিটেডের ভান্ডার এবং তহবিল খতিয়ে দেখে সেই রাজ্যের আবগারি এবং আয়কর দফতর। গত বছর এই সংস্থা রাজ্যে ১৩৫ কোটি টাকার ব্যবসা করেছিল। আদানি নিয়ে হিন্ডেনবার্গের রিপোর্টে ‘ষড়যন্ত্র’ হয়েছে! তদন্ত চেয়ে সুপ্রিম কোর্টে জনস্বার্থ মামলা দায়ের করেছেন আইনজীবী এমএল শর্মা এবং বিশাল তিওয়ারি। আগামীর হয়ে ব্যাট ধরেন ভারতের প্রাক্তন ক্রিকেটার বীরেন্দ্র শেওয়াগ। ভারতের বিরুদ্ধে পশ্চিমী দেশগুলির সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র বলে অভিযোগ করে সেওয়াগ টুইট করে লেখেন, ‘বিদেশিরা ভারতের অগ্রগতি সহ্য করতে পারে না। ভারতীয় বাজারে ‘হিট জব’ একটি সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের মতো মনে হচ্ছে। কিন্তু তারা যতই চেষ্টা করুক না কেন, ভারত শক্তিশালী হয়ে ঘুরে দাঁড়াবে।’
তবে, আদানি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে হিন্ডেনবার্গের রিপোর্ট নিয়ে সংসদেও উঠেছে ঝড়। আদানি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে তদন্তের দাবি তুলেছে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি। দফায় দফায় মুলতুবি হয়েছে সংসদের বাজেট অধিবেশন। বিরোধীরা যৌথ সংসদীয় কমিটি গড়ে কিংবা সুপ্রিম কোর্টের নজরদারিতে আদানিকাণ্ডের তদন্তের দাবি তুলেছেন। তবে আদানি কান্ডের পর ব্যাংকে টাকা রাখা নিরাপদ বলেই আশ্বস্ত করেছে রিজার্ভ ব্যাংক অফ ইন্ডিয়া। বিজ্ঞপ্তিতে আরবিআই লিখেছে, ভারতের ব্যাঙ্কগুলি নিরাপদ এবং সুরক্ষিত রয়েছে। পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের আশ্বাস, প্রতিনিয়ত পরিস্থিতির উপর নজর রাখা চলছে। আর এই আবহে ফের নতুন করে আদানির বিরুদ্ধে বিলিয়ন ডলারের চুক্তির কারচুপির অভিযোগ। শুধি তাই নয়, বড়সড় প্রশ্ন চিহ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে ভারত-আমেরিকার কূটনৈতিক সম্পর্ককেও।