ট্রাইব টিভি বাংলা ডিজিটাল: প্লে-অফের দৌড়ে টিকে থাকতে হলে রবিবার ইডেনে রাজস্থান রয়্যালসের বিরুদ্ধে জয় ছাড়া কোনও গতি ছিল না কলকাতা নাইট রাইডার্সের। রুদ্ধশ্বাস ম্যাচে হৃদস্পন্দন বাড়িয়ে এক রানে জিতে প্লে-অফে ওঠার দিকে আরও কিছুটা এগিয়ে থাকলো নাইটরা (Kolkata Knight Riders)। ১৪ বছর বয়সী রাজস্থানের বৈভব সূর্যবংশী ম্যাজিক দেখাতে না পারলেও ‘ডু অর ডাই’ ম্যাচে কেকেআরের ‘মাসলম্যান’ আন্দ্রে রাসেল আরও একবার বুঝিয়ে দিলেন বুড়ো হাড়ে ভেলকি দেখিয়ে এখনও বলে বলে তিনি গ্যালারিতে বল পাঠাতে পারেন। রাসেল ঝরে ঢাকা পড়ে গেল রাজস্থান অধিনায়ক রিয়ান পরাগের অনবদ্য ইনিংসও। সেই সঙ্গে ঘরের মাঠে গুরুত্বপূর্ণ জয়ও তুলে নিল কেকেআর।
ফাঁকা ইডেনে স্পেশাল দর্শক সাউথগেট (Kolkata Knight Riders)
রবিবারের দুপুর। ছুটির দিনে কেকেআরের গুরুত্বপূর্ণ খেলা। তবুও ম্যাচ শুরুর আধঘন্টা আগেও ইডেন চত্বর প্রায় শুনশান। গ্যালারিও অর্ধেকের বেশি ফাঁকা। তাহলে কি শহরের ক্রিকেটপ্রেমীরা ধরেই নিয়েছিলেন যে, রবিবার ইডেনে রাজস্থানের ১৪ বছর বয়সী বিস্ময় ব্যাটার বৈভব সূর্যবংশীর ব্যাটে ওঠা ঝড়ে কেকেআর-এর প্লে-অফের স্বপ্নভঙ্গ হতে চলেছে? কেকেআর-এ কি মোহভঙ্গ হল কলকাতার ক্রিকেটপ্রেমীদের? না হলে ছুটির দিনে এত ফাঁকা কেন ইডেনের গ্যালারি! এই প্রশ্নই উঁকি দিচ্ছিল সকলের মনে।
আরও পড়ুন: IPL 2025 : সূর্যবংশীর বৈভবে মজে ইডেন, রাজস্থানের বিরুদ্ধে ডু অর ডাই ম্যাচে নামছে নাইটরা
তবে সূর্যবংশীর বৈভব নয়, রবিবাসরীয় ইডেনে মরশুমের সেরা পারফরম্যান্স করে মাঠমুখো ক্রিকেটপ্রেমীদের মনোরঞ্জন করলেন রাসেল। সন্ধ্যায় রাসেল ম্যানিয়ায় আক্রান্ত হয়েই হাসিমুখে ঘরে ফিরলেন নাইট প্রেমীরা। রাসেল ম্যানিয়ায় আক্রান্ত হলেন ইডেনে রাজস্থান রয়্যালসের হয়ে গলা ফাটাতে আসা ইংল্যান্ড জাতীয় ফুটবল দলের প্রাক্তন কোচ গ্যারেজ সাউথগেট’ও।
নাইট একাদশে বদল (Kolkata Knight Riders)
প্লে-অফের দৌড় থেকে আগেই ছিটকে গিয়েছিল রাজস্থান। কিন্তু প্রতিযোগিতায় অস্তিত্ব বাঁচিয়ে রাখার লড়াই ছিল কেকেআরের কাছে। তাই রিয়ান পরাগদের বিরুদ্ধে দলে বেশ কিছু পরিবর্তন করেছিল নাইটরা। প্রথম একাদশে জায়গা হয়নি পেসার হর্ষিত রানা, অনুকূল রায়দের। বদলে প্রথম একাদশে জায়গা পান মঈন আলি ও রামনদীপ সিং। পরিবর্তন হয় নাইটদের ব্যাটিং লাইন আপেও। টানা ম্যাচে ব্যর্থ হওয়া দলের সহ অধিনায়ক ভেঙ্কটেশ আইয়ারের জায়গায় আসেন ছন্দে থাকা অঙ্কৃশ রঘুবংশী।

শুরুতে জমল না নাইট ব্যাটিং (Kolkata Knight Riders)
রবিবার টসে জিতে প্রথমে ব্যাটিংয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন নাইট অধিনায়ক অজিঙ্কা রাহানে। দুই নাইট ওপেনার সুনীল নারিন ও গুরবাজ শুরুটা মন্দ করেননি। কিন্তু এই জুটি বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। নারিন (১১) জমে ওঠার আগেই দ্বিতীয় ওভারে তাঁকে ফিরিয়ে নাইট শিবিরে প্রথম আঘাত হানেন যুধবীর সিং । এরপর গুরবাজ ও অধিনায়ক রাহানে দলের হাল ধরেন (Kolkata Knight Riders)। ভালোই এগোচ্ছিল এই জুটি।
কিন্তু অষ্টম ওভারে ছন্দে ফিরতে থাকা গুরবাজকে (২৫ বলে ৩৫ রান) ফিরিয়ে দেন রাজস্থানের স্পিনার মহেশ থিকসানা। ৭.৩ ওভারে নাইট উইকেটকিপার যখন আউট হন তখন দলের রান ২ উইকেটে ৬৯। দ্বিতীয় উইকেটে দু’জনের জুটিতে ওঠে ৫৬ রান। গুরবাজ ফিরে যেতেই নাইটদের রানের গতি কিছুটা স্লথ হয়ে যায়। রাহানে ও অঙ্কৃশ জুটি ১১.৩ ওভারে দলকে পৌঁছে দেন শতরানের ঘরে। এই জুটিও ভালোই এগোচ্ছিল। দু’জনেই যেভাবে ব্যাট করছিলেন তাতে মনে হচ্ছিল বড় রান পেতেই পারতেন। না তা আর হয়নি। ওভারে রিয়ান পরাগের বলে উইকেটরক্ষক ধ্রুব জুড়েলের হাতে ক্যাচ দিয়ে ব্যক্তিগত ৩০ রান করে ফিরলেন রাহানে।
ইডেনে রাসেলের ব্যাটে ঝড় (Kolkata Knight Riders)
রাহানে যখন ফিরলেন তখন কেকেআর-এর রান ১২.৪ ওভারে ৩ উইকেটে ১১১। স্কোরবোর্ডে বড় রান তুলতে না পারলে চাপ যে বাড়বে, তা ভাল মতই জানতো নাইট টিম ম্যানেজমেন্ট। তাই রাহানে ফিরতেই রাসেলকে পাঠায় নাইটরা। তাতে লাভ কী হল, তার সাক্ষির থাকল গোটা ইডেন। শেষ ৭ ওভারে নাইটরা তুলল ৯৫ রান। প্রথমে কিছুটা ধরেই খেলছিলেন রাসেল। ৮ বলে ২ রান করায় গ্যালারিতেও রাসেলকে নিয়ে গুঞ্জন বাড়ছিল। কিন্তু তারপরই রাসেলের ব্যাটে ইডেনে হঠাৎ উঠল কালবৈশাখী ঝড়। আর তাতেই লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল রাজস্থান। মাধওয়াল, আর্চার, থিকসানাদের তখন বলে বলে গ্যালারিতে পাঠানোর নেশায় মেতে উঠেছেন ‘ক্যারিবিয়ান দৈত্য’।

২২ বলে নিজের অর্ধ্বশতরান পূর্ণ করে নেন ক্যারিবিয়ান ব্যাটার (Kolkata Knight Riders)। শেষে ২৫ বলে ৪ বাউন্ডারি ও হাফ ডজন ওভার বাউন্ডারির সাহায্যে ৫৭ রান করে অপরাজিতা থেকে যান ম্যাচের সেরা রাসেল। চলতি মরশুমে এই প্রথম হাফ সেঞ্চুরি এল রাসেলের ব্যাটে। অঙ্কৃশ ৩১ বলে ৫ বাউন্ডারির সাহায্যে ৪৪ রান করেন। ১৯তম ওভারের প্রথম বলে তাঁকে ফেরান আর্চার। চতুর্থ উইকেটে দু’জনের পার্টনারশিপে ওঠে ৩৩ বলে ৬১ রান। রঘুবংশী জায়গায় নামা রিঙ্কু যেন রাসেলকে দেখে অনুপ্রাণীত হয়েই নেমেছিলেন। তাঁর ওভার বাউন্ডারিতেই নাইটরা ২০০-এর গণ্ডি পার করে ২০৬ রানের টার্গেট খাড়া করে। শেষে ৬ বলে এক বাউন্ডারি ও জোড়া ওভার বাউন্ডারির সাহায্যে ১৯ রান করে অপরাজিতা থেকে যেন রিঙ্কু।
বরুণ-মঈনের জোড়া ধাক্কায় বেসামাল রাজস্থান (Kolkata Knight Riders)
জবাবে ব্যাট করতে নেমে নাইট পেশার বৈভব অরোরার প্রথম ওভারের চতুর্থ বলেই ‘বেবি বস’ বৈভব সূর্যবংশীর উইকেট হারায় রাহুল দ্রাবিড়ের দল। আগের বলেই সুন্দর কভার ড্রাইভে বাউন্ডারিতে বল পাঠিয়েছিলেন বৈভব। কিন্তু অতিরিক্ত ওভার বাউন্ডারি হাঁকানোর নেশাই পতন ডেকে আনল। পরের বলেই পুল করতে গিয়ে ব্যক্তিগত ৪ রানের মাথায় আউট হলেন বৈভব। তার দুরন্ত ক্যাচ তালুবন্দি করলেনন নাইট অধিনায়ক রাহানে (Kolkata Knight Riders)। সেই ধাক্কা সামলে ওঠার আগেই পরের ওভারেই রাজস্থান শিবিরের দ্বিতীয় আঘাতটা হানেন মঈন আলি। বৈভবের জায়গায় নামা কুনাল সিং রাঠোরকে খাতা খোলার আগেই ফিরিয়ে দেন তিনি। ৮ রানে ২ উইকেট হারিয়ে শুরুতেই যথেষ্ট চাপে পড়ে যায় রাজস্থান।

কিন্তু সেই চাপ থেকে দলকে টেনে তুলতে থাকেন যশস্বী জয়সওয়াল ও অধিনায়ক রিয়ান পরাগ। শুরুতে দ্রুত উইকেট হারালেও বড় লক্ষ্যমাত্রার কথা মাথায় রেখে ভয়ডরহীন ব্যাটিং করতে শুরু করেন দু’জনে। ৫.২ ওভারেই দলকে পঞ্চাশের ঘরে পৌঁছে দেয় এই জুটি। তারপর অবশ্য সপ্তম ওভারের শেষ বলে যশস্বীকে ফিরিয়ে দেন সেই মঈন। ২১ বলে ৩৪ রান করে ফেলেন রাজস্থানের ওপেনার। আর তাতেই রাজস্থানের আবারও ছন্দপতন। পরের ওভারেই বল করতে এসে জোড়া ধাক্কা দেন নাইট স্পিনার বরুণ চক্রবর্তী। অষ্টম ওভারের তৃতীয় ও পঞ্চম বলে ধ্রুব জুড়েল (০) ও ওয়ানেন্দু হাসারাঙ্গা (০) ফিরে যান।
বিধ্বংসী পরাগ-হেটমেয়ার জুটি (Kolkata Knight Riders)
৭১ রানের মধ্যে ৫ উইকেট হারিয়ে রীতিমতো চাপে পড়ে যায় মরু শহরের দলটি। তবে স্কোরবোর্ড রান তোলার গতি কমতে দেননি অধিনায়ক পরাগ এবং সিমরান হিটমেয়ার। উল্টে আরো ভয়ংকর হয়ে ওঠেন রাজস্থান অধিনায়ক রিয়ান পরাগ। ১১৫ ওভারেই ১০০ রান তুলে ফেলে রাজস্থান। তখনো মনে হচ্ছিল ম্যাচ কেকেআরের দিকেই। কিন্তু ১৩ তম ওভারে গোটা স্টেডিয়ামে নীরবতা নামিয়ে আনেন পরাগ। মঈন আলির ওই ওভারে রাজস্থান তলে ৩২ রান।
প্রথম বলে হেডমিয়ার সিঙ্গেল নেন। এরপর বাকি পাঁচ বলে পাঁচটি ছক্কা হাঁকান পরাগ। তার মধ্যে একটি ওয়াইড হয়। ১২ ওভারে ১০২ রান থেকে ১৩ ওভারে ১৩৪ রানে পৌঁছে যায় রাজস্থান। তারসঙ্গে ২৭ বলে নিজের হাফ সেঞ্চুরিও পূর্ণ করে ফেলেন পরাগ। এক নিমিষে কেকেআরের থেকে ম্যাচের রাস চলে আসে রাজস্থানের দিকে। উল্টে নাইট শিবিরে ঢুকে পড়ে হেরে প্লে-অফের দৌড় থেকে ছিটকে যাওয়ার ভূকুটি।
আরও পড়ুন: Gareth Southgate: রাজস্থানের জার্সিতে মাঠে প্রাক্তন ইংল্যান্ড কোচ
হর্ষিত রানার জোড়া ধাক্কা (Kolkata Knight Riders)
পরাগ ও হেটমেয়ার জুটি যেভাবে ভয়ংকর হয়ে উঠছিল, তাতে তখন রান আটকানো নয়, নাইটদের দরকার ছিল উইকেট। ওই একটা বড় ওভার রাজস্থানের দুই ব্যাটসম্যানের আত্মবিশ্বাসটা অনেকটাই বাড়িয়ে দিয়েছিল। আর সেখান থেকে তাঁদের থামানো সম্ভবই হচ্ছিল না কোনও নাইট বোলারের। দু’জনের ব্যাট তখন যত গর্জে উঠছিল ততই টেনশন বাড়ছিল নাইট ডাগআউটে। ঠিক সেই সময়ই হেটমেয়ারকে ফিরিয়ে ভয়ংকর হয়ে ওঠা এই জুটিকে ভাঙ্গেন নাইট পেসার হর্ষিত রানা। ২৩ বলে ২৯ রান করে নারিনের হাতে ক্যাচ দিয়ে ফেরেন তিনি (Kolkata Knight Riders)।

ষষ্ঠ উইকেটে দুজনের পার্টনারশিপে উঠে ৪৮ বলে ৯২ রান। তখন ১৫.৫ ওভারে ৬ উইকেটে রাজস্থানের রান ১৬৩। জয়ের জন্য তখনও রাজস্থানের দরকার ২৫ বলে ৪৪ রান। তখনও উইকেটে বিধ্বংসী পরাগ। ফলে নাইট শিবিরে তখনও আতঙ্ক অব্যাহত। প্রায় সকলেই ধরে নিয়েছিল নাইটদের হার নিশ্চিত। কিন্তু ১৮তম ওভারের চতুর্থ বলে সেই হর্ষিত ভয়ংকর পরাগকে ফিরিয়ে দিতেই কিছুটা টেনশনমুক্ত হয় নাইট শিবির। ৪৫ বলে ছয় বাউন্ডারি ও আট ওভার বাউন্ডারির সাহায্যে অনবদ্য ৯৫ রানের ইনিংস খেলে বৈভব অরোরার হাতে ক্যাচ দিয়ে প্যাভিলিয়নে ফেরেন রাজস্থান অধিনায়ক পরাগ। আর সেটাই ম্যাচের টার্নিং পয়েন্ট তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
শেষ ওভারে রোমাঞ্চ (Kolkata Knight Riders)
পরাগ ফিরতেই মাঠে উপস্থিত নাইট সমর্থকরা জয় নিয়ে নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু নাটক যে তখনও বাকি ছিল তাকেও বুঝতে পারেনি। শেষ ওভারে রাজস্থানের জয়ের জন্য দরকার ছিল ২২ রান। দুই রাজস্থানী ব্যাটার শুভম দুবে এবং জফ্রে আর্চার চার ও ছক্কা হাঁকিয়ে বৈভবের শেষ ওভারকে আরও রোমাঞ্চকর করে তোলেন। শেষ বলে রাজস্থানের জয়ের জন্য দরকার ছিল তিন রান। দু’রান হলেই সুপার ওভার। কিন্তু দ্বিতীয় রান নেওয়ার সময় রিঙ্কু সিঙের দুরন্ত থ্রোয়ে রান আউট হয়ে যান আর্চার। শেষে মাত্র এক রানে রোমহর্ষক জয় তুলে নেয় কেকেআর।

৬ নম্বরে উঠে এল কেকেআর (Kolkata Knight Riders)
রাজস্থান রয়্যালসের বিরুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ এই ম্যাচ জিতে পয়েন্ট তালিকায় ৬ নম্বরে উঠে এল কলকাতা নাইট রাইডার্স। ১১ ম্যাচে নাইটদের পয়েন্ট ১১। হাতে রয়েছে আর তিনটি ম্যাচ। প্লে-অফে আশা বাঁচিয়ে রাখতে হলে পরের তিনটে ম্যাচই জিততে হবে নাইটদের। সেই সঙ্গে প্রথম চারে থাকা দলগুলিকেও পরের ম্যাচগুলোতে পয়েন্ট খোয়াতে হবে। তবেই প্লে-অফ এ যাওয়া নিশ্চিত হবে নাইটদের। অংক খুবই জটিল। তবুও হাল ছাড়তে রাজি নয় নাইট শিবির (Kolkata Knight Riders)। পরের তিনটি ম্যাচকেই ফাইনাল ধরে নিয়েই মাঠে নামতে চান বলে জানিয়ে দিলেন রবিবারের নায়ক তথা ম্যাচের সেরা আন্দ্রে রাসেল।