ট্রাইব টিভি বাংলা ডিজিটাল: ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল এমন এক ব্যক্তিত্ব, যিনি দীর্ঘ চার দশকেরও বেশি সময় ধরে ভারতের নিরাপত্তা এবং গোয়েন্দা জগতের গুরুত্বপূর্ণ পরিকল্পনাকারী এবং রূপকার হিসেবে কাজ করে এসেছেন (NSA Ajit Doval)। কখনও ছায়ায় থেকে, কখনও সামনে এসে—তিনি ভারতের জন্য সম্পাদন করেছেন একাধিক সাহসী, কৌশলী এবং ফলপ্রসূ অপারেশন। তাঁর কৃতিত্বের তালিকা শুধু দীর্ঘ নয়, অবিশ্বাস্য রকমের রোমাঞ্চকর এবং জটিলও।
ছায়াযুদ্ধের অধ্যায় শুরু (NSA Ajit Doval)
১৯৪৫ সালের ২০ জানুয়ারি উত্তরাখণ্ডের পৌরীতে জন্মগ্রহণকারী অজিত দোভাল (Ajit Doval) ১৯৬৮ সালে কেরালায় আইপিএস অফিসার হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। খুব অল্প সময়েই তিনি নিজেকে একজন প্রতিভাবান গোয়েন্দা এবং অপারেশন বিশেষজ্ঞ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীতে তিনি ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো (IB)-তে যোগ দেন এবং সেখানেই শুরু হয় তাঁর প্রকৃত ছায়াযুদ্ধের অধ্যায়।
অপারেশন ১: গোল্ডেন টেম্পল এবং ‘ব্লু স্টার’-এর ছায়াযোদ্ধা (NSA Ajit Doval)
অজিত দোভালের কেরিয়ারের প্রথম এবং অন্যতম আলোচিত কীর্তি হলো ১৯৮৪ সালের অপারেশন ব্লু স্টার-এ তাঁর গোপন ভূমিকা(NSA Ajit Doval)। খালিস্তান আন্দোলনের সময় অমৃতসরের স্বর্ণমন্দিরে জঙ্গিরা আশ্রয় নেয়। ভারত সরকার কঠোর সিদ্ধান্ত নেয় সেনাবাহিনী দিয়ে অপারেশন চালানোর।অজিত দোভাল ছদ্মবেশে, এক মুসলিম পিলগ্রিম হিসেবে, বেশ কিছুদিন ধরে মন্দির চত্বরে প্রবেশ করে জঙ্গিদের কার্যকলাপ সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করেন। তিনি জঙ্গিদের মনস্তত্ত্ব, অস্ত্রভান্ডার এবং কৌশল সম্পর্কে বিস্তারিত রিপোর্ট পাঠান সেনাবাহিনীকে। তাঁর দেওয়া তথ্যেই শেষমেশ সফলভাবে সেনা অভিযানে হস্তক্ষেপ করা সম্ভব হয়। বলা হয়ে থাকে, তাঁর এই কাজ অপারেশন ব্লু স্টার-এর মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল।

অপারেশন ২: সাত বছর পাকিস্তানে গুপ্তচর হিসেবে(NSA Ajit Doval)
একজন গোয়েন্দার জীবনে সবচেয়ে কঠিন কাজ হলো শত্রুপক্ষের মাটিতে দীর্ঘ সময় অবস্থান করা(NSA Ajit Doval)। দোভাল এই কাজটি করেছেন সাত বছরেরও বেশি সময় ধরে। তিনি পাকিস্তানে ‘আন্ডারকভার’ অবস্থায় ছিলেন এবং সেখান থেকে গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ও কৌশলগত তথ্য সংগ্রহ করে ভারতে পাঠাতেন। তাঁর এই সময়কাল ছিল অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ, কারণ সামান্য ভুলে প্রাণ হারানোর আশঙ্কা ছিল প্রবল।যদিও এই বিষয়ে সরকারিভাবে খুব বেশি তথ্য প্রকাশ করা হয়নি, কিন্তু প্রাক্তন গোয়েন্দা ও প্রতিরক্ষা আধিকারিকদের মতে, পাকিস্তানের গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ও পরমাণু তথ্য সংগ্রহে দোভালের ভূমিকা ছিল অনন্য।

অপারেশন ৩: ১৯৯৯-এ কান্দাহার অপহরণ সংকটে কূটনৈতিক নেতৃত্ব(NSA Ajit Doval)
১৯৯৯ সালে ভারতীয় বিমান সংস্থা IC-814-র হাইজ্যাকিং ভারতের ইতিহাসে অন্যতম কঠিন পরিস্থতি তৈরি করেছিল(NSA Ajit Doval)। আফগানিস্তানের কান্দাহারে অপহৃত বিমানটিতে ১৭৬ জন যাত্রী ছিলেন। তাঁদের মুক্তির বিনিময়ে মুক্তি দেওয়া হয় তিনজন কুখ্যাত জঙ্গিকে, যাদের একজন ছিল পরবর্তী কালে ২৬/১১ হামলার মাস্টারমাইন্ড মাসুদ আজহার।যদিও এই সিদ্ধান্ত বিতর্কিত ছিল, তবু দোভাল সেসময় কাবুল ও কান্দাহারের মধ্যে সমন্বয় রক্ষা করে যাত্রীদের প্রাণ রক্ষা করেন। তিনি তালিবানদের সঙ্গে কঠিন কূটনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছিলেন।

আরও পড়ুন: Chinmoy Krishna Das: জামিনের আবেদন মঞ্জুর হওয়ার পর ফের গ্রেফতার চিন্ময়কৃষ্ণ
অপারেশন ৪: মিজোরাম ও উত্তর-পূর্বে শান্তি প্রতিষ্ঠা(NSA Ajit Doval)
দোভালের নেতৃত্বে মিজোরাম বিদ্রোহ দমন এবং শান্তি চুক্তি বাস্তবায়ন ছিল একটি উল্লেখযোগ্য সাফল্য(NSA Ajit Doval)। তিনি মিজো ন্যাশনাল ফ্রন্ট (MNF)-এর নেতাদের সঙ্গে গোপন বৈঠক করে তাদের আত্মসমর্পণে রাজি করান এবং রাজ্যে শান্তি ফেরাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন।উত্তর-পূর্ব ভারতের বিভিন্ন বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে দোভালের পরিচালিত মনস্তাত্ত্বিক এবং কৌশলগত অপারেশনগুলো দীর্ঘমেয়াদি শান্তির ভিত তৈরি করে দেয়।
অপারেশন ৫: সার্জিক্যাল স্ট্রাইক এবং বালাকোট এয়ারস্ট্রাইক
জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হিসেবে অজিত দোভালের সবচেয়ে আলোচিত অপারেশন ছিল ২০১৬-র সার্জিক্যাল স্ট্রাইক এবং ২০১৯-এর বালাকোট এয়ারস্ট্রাইক। উরি হামলার পর ভারত পাকিস্তানের ভূখণ্ডে ঢুকে জঙ্গি ঘাঁটি ধ্বংস করে। এই অভূতপূর্ব অভিযান ভারতের কৌশলগত নীতির পালাবদল নির্দেশ করে।পরবর্তীতে পুলওয়ামা হামলার জবাবে বালাকোটে এয়ারস্ট্রাইক চালানো হয়। এই দুটি ঘটনাতেই দোভালের ভূমিকা ছিল কেন্দ্রীয়। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করে তিনি পুরো অপারেশনের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন করেন।
কূটনীতির ইতিহাসে অজিত দোভাল
অজিত দোভাল শুধুমাত্র একজন গোয়েন্দা বা আমলা নন, তিনি ভারতের জাতীয় নিরাপত্তার কৌশলগত স্থপতি। ‘ডোভাল ডকট্রিন’ নামে পরিচিত তাঁর রণনীতি মূলত আক্রমণাত্মক প্রতিরক্ষা নীতিকে কেন্দ্র করে গঠিত, যা কূটনীতি, গোয়েন্দা তথ্য, মনস্তাত্ত্বিক কৌশল এবং সামরিক অভিযানের সুচারু সমন্বয় ঘটায়।তাঁর জীবনের অপারেশনগুলো শুধু সাহসিকতার নজির নয়, বরং রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার প্রয়োজনে ‘শত্রুর ছায়ায় ঢুকে’ তাকে চুপিসারে পর্যবেক্ষণ করার এক অনন্য কৌশল।ভারতীয় গোয়েন্দা এবং কূটনীতির ইতিহাসে অজিত দোভাল এক কিংবদন্তি নাম। তিনি প্রমাণ করেছেন, প্রকৃত বীর সবসময় আলোয় থাকেন না—অনেক সময় তাঁরা ছায়ার মধ্যেই ইতিহাস গড়ে তোলেন।