ট্রাইব টিভি বাংলা ডিজিটাল: ১৮৮৩ সালের এক সন্ধ্যাবেলায় কর্ণাটকের কারোয়ার উপকূলে দাঁড়িয়ে এক যুবক পাথরের উপর লিখেছিলেন চার পঙক্তির একটি কবিতা(Pashan Hriday Tagores Sculpture)। সেই যুবক তখনও বিশ্বকবি নন, তবে মনের গহনে বয়ে চলেছে প্রেম, প্রত্যাখ্যান আর শিল্পসৃষ্টির অভিমানী ঝড়। তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাঁর হাতে গড়া একমাত্র ভাস্কর্য—‘পাষাণহৃদয়’, আজ, ১৪২ বছর পর মুম্বইয়ের অষ্টগুরু নিলামঘরে উঠতে চলেছে নিলামে।
একটি পাথরের অভিমানের ইতিহাস (Pashan Hriday Tagores Sculpture)
কারোয়ারে বেড়াতে গিয়ে উত্তুঙ্গ ঢেউ, ঝাউবন আর উপকূলের নিঃসঙ্গতায় কবির মনে ফিরে আসে জীবনের অন্তরঙ্গ কিন্তু অপঠিত এক অধ্যায়—কাদম্বরী দেবীর অনাসক্তি (Pashan Hriday Tagores Sculpture)। সেই যন্ত্রণা, সেই অমোচনীয় দাগ পাথরে খোদাই করেই তিনি বানিয়েছিলেন এক ক্ষুদ্র কবিতা-ভাস্কর্য—“পাষাণ হৃদয় কেটে/ খোদিনু নিজের হাতে/ আর কি মুছিবে লেখা/ অশ্রুবারিধারাপাতে?”
এই চার লাইনের মধ্যেই যেন ধরা পড়ে রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিগত ইতিহাসের এক গোপনতম ব্যথা। জীবনস্মৃতিতে ছড়িয়ে থাকা ইঙ্গিত, জ্যোতিরিন্দ্রনাথের উদাসীনতার জেরে কাদম্বরীর আত্মহনন এবং তাঁর ‘নির্লিপ্তি’—সব মিলিয়ে এই ভাস্কর্য হয়ে উঠেছে রবীন্দ্র-চরিতের এক অনুপম অথচ গভীর নিদর্শন।
এক ‘ভ্রান্ত ব্যাখ্যার’ প্রতিবাদ? (Pashan Hriday Tagores Sculpture)
কাদম্বরীর আত্মহত্যার দায় রবীন্দ্রনাথের (Rabindranath Tagore) দিকে ছুড়ে দিয়েছিল বঙ্গীয় সামাজিক চেতনার একাংশ(Pashan Hriday Tagores Sculpture)। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ নিজেই তাঁর লেখায়, স্মৃতিচারণে, এমনকি এই পাথরের শিলালিপিতে যেন জানান দেন—এই সম্পর্ক একতরফা ছিল, বৌঠানের কাছে কবির ভালবাসা ফিরেও আসেনি। এই ‘পাষাণহৃদয়’ যেন সেই অননুরণিত প্রেমের চিরস্থায়ী স্মারক।

আরও পড়ুন: Ali Khamenei : যুদ্ধবিরতির পরে উধাও খামেনেই! ইরানে জল্পনার ঢেউ, কোথায় রয়েছেন আয়াতোল্লা?
উত্তরাধিকার ও নিলামে উত্তরণ (Pashan Hriday Tagores Sculpture)
পাথরটি প্রথমে কবি উপহার দেন বন্ধু অক্ষয় চৌধুরীকে। পরে সেটি যায় তাঁর স্ত্রী শরৎকুমারী, তাঁদের কন্যা উমারানি, এবং পরবর্তী প্রজন্মের হাত ঘুরে ইলোরা বসুর হেফাজতে (Pashan Hriday Tagores Sculpture)। দীর্ঘদিন ব্লুমিংটনের এক ব্যাঙ্ক লকারে থাকার পর ২০২৪ সালে কলকাতার এক প্রদর্শনীতে সর্বসমক্ষে আসে ‘পাষাণহৃদয়’।
আজ সেটি ৭-৮ কোটি টাকায় নিলামে উঠতে পারে। সঙ্গে থাকবে আরও এক দুর্লভ ধন—৩৫টি হাতে লেখা রবীন্দ্রচিঠি, যেগুলি প্রেরিত হয় সমাজতাত্ত্বিক ধুর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়কে। এই চিঠিগুলিতে আমরা দেখতে পাই এক আত্মবিশ্বাসী, সজীব ও সাহসী রবীন্দ্রনাথকে—যিনি সাহিত্যে শুচিবায়ু, সঙ্গীতে গোঁড়ামি, এবং নৃত্যকলায় ছকে বাঁধা ধ্যানধারণার বিরুদ্ধে বারবার প্রশ্ন তুলেছেন।

এ কি শুধু সম্পত্তি? (Pashan Hriday Tagores Sculpture)
নিলামঘরের নিয়ম অনুযায়ী, এই সম্পদ দেশের বাইরে নিয়ে যাওয়া যাবে না(Pashan Hriday Tagores Sculpture)। কিন্তু প্রশ্ন উঠে যায়—এই ভাস্কর্য ও চিঠিগুলি কি শুধুই আর্থিক লেনদেনের উপকরণ? এগুলি কি জাতীয় সম্পদ নয়? একজন ব্যক্তির ব্যক্তিগত ভান্ডারে, অথবা কোনও শিল্প সংগ্রাহকের গোপন ঘরে বন্দি হয়ে গেলে, আমরা কি চিরতরে হারাব না এক জন রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিগত শিল্পবোধ, হৃদয়ের জার্নাল?
শুধু সম্পত্তি নয়,ঐতিহ্য, আত্মপরিচয়, ইতিহাস (Pashan Hriday Tagores Sculpture)
এ প্রশ্ন নতুন নয়, উত্তরও ততটাই পুরনো—“না, এগুলি শুধু সম্পত্তি নয়, এগুলি ঐতিহ্য, আত্মপরিচয়, ইতিহাস।”
কিন্তু এই জ্ঞানে কখনও আইনের সিলমোহর পড়ে না। রাষ্ট্র নীরব, সরকার নির্বিকার, সমাজ বিস্মৃত। এই ‘পাষাণহৃদয়’—ভাস্কর্য তো বটেই, সে এক নীরব আর্তনাদ—যা যেন আজও বলে চলেছে— “আর কি মুছিবে লেখা, অশ্রুবারিধারাপাতে?”