ট্রাইব টিভি বাংলা ডিজিটাল: প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে মরিশাসে স্বাগত জানিয়েছেন ভারতীয় প্রবাসীরা (PM Modi Mauritius Visit)। ১২ মার্চ মরিশাসের জাতীয় দিবস উদযাপনের জন্য দুই দিনের সফরে মোদী মরিশাসে আছেন। কিন্তু কেন ভারতের সঙ্গে ঐতিহাসিক সম্পর্কযুক্ত এই ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্রটি নয়াদিল্লির জন্য কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
জাতীয় দিবস উপলক্ষে মরিশাস সফরে প্রধানমন্ত্রী (PM Modi Mauritius Visit)
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী মরিশাস সফরে গিয়ে ভারতীয় প্রবাসীদের কাছ থেকে উষ্ণ অভ্যর্থনা পেলেন (PM Modi Mauritius Visit)। মরিশাসের জাতীয় দিবস উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে তাঁকে “বড়সড় বিহারি স্বাগত” জানানো হয়। ১২ মার্চ মরিশাসের জাতীয় দিবসে মোদী প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন। ভারত ও মরিশাসের সম্পর্ক কেবল ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে নয়, বরং দীর্ঘ ঐতিহাসিক এবং কৌশলগত কূটনৈতিক সম্পর্কের ভিত্তিতেও গড়ে উঠেছে। মরিশাসের পশ্চিম ভারত মহাসাগরে কৌশলগত অবস্থান রয়েছে এবং এটি ভারতের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী।
ভারতীয় প্রবাসীদের ভূমিকা মরিশাসে (PM Modi Mauritius Visit)
মরিশাসে ভারতীয় বংশোদ্ভূত মানুষের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য, যা প্রায় ৭০ শতাংশ। মোট জনসংখ্যা প্রায় ১২ লক্ষ (PM Modi Mauritius Visit)। এই দ্বীপ রাষ্ট্রে মহাত্মা গান্ধী ইনস্টিটিউট এবং ইন্দিরা গান্ধী সেন্টার ফর ইন্ডিয়ান কালচার গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। এছাড়াও মরিশাসের বহুল জনপ্রিয় ভোজপুরি ব্যান্ড ও শিল্পীরা ভারতীয় সংস্কৃতির প্রসার ঘটিয়েছেন। ভোজপুরি বয়েজ, নীরজ গুপ্ত মুধু, বিনোদ সেওদুথ-এর মতো জনপ্রিয় গায়করা মরিশাসে ব্যাপক পরিচিত।
মরিশাসের স্বাধীনতা ও ভারতীয় সংযোগ (PM Modi Mauritius Visit)
মরিশাসের স্বাধীনতা দিবসও ভারতের সঙ্গে বিশেষভাবে জড়িত (PM Modi Mauritius Visit)। ১৯০১ সালে মহাত্মা গান্ধী দক্ষিণ আফ্রিকা যাওয়ার পথে মরিশাসে একবার থেমেছিলেন। সেখানে তিনি ভারতীয় অভিবাসীদের সঙ্গে শিক্ষা, রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন ও শিকড়ের সঙ্গে সংযুক্ত থাকার গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করেন। ১২ মার্চই গান্ধীজি ঐতিহাসিক ডান্ডি মার্চ শুরু করেছিলেন, যা মরিশাসের স্বাধীনতা দিবসের তারিখের সঙ্গে এক কাকতালীয় সংযোগ গড়ে তুলেছে।
ভারত-মরিশাস সম্পর্কের ইতিহাস (PM Modi Mauritius Visit)
১৭০০ সাল নাগাদ ফরাসি ঔপনিবেশিক শাসনের সময় ভারতীয়রা মরিশাসে বসতি স্থাপন শুরু করে (PM Modi Mauritius Visit)। তখন পুদুচেরি থেকে কারিগর ও নির্মাণশ্রমিকরা মরিশাসে কাজের জন্য আসতে থাকেন। ১৮০০ সালের দিকে ব্রিটিশরা ক্ষমতা গ্রহণ করলে, ফরাসিদের অধীনে প্রচলিত দাসপ্রথা বিলুপ্ত হয়। ১৮৩০ থেকে ১৯০০ সালের মধ্যে ৫ লক্ষেরও বেশি ভারতীয় চুক্তিবদ্ধ শ্রমিক হিসেবে মরিশাসে যান।
আরও পড়ুন: WhatsApp Group: হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ থেকে বের করে দিয়েছিলেন অ্যাডমিন, রাগে খুন যুবককে
১৮৩৪ সালে ‘Atlas’ নামের একটি বিখ্যাত জাহাজ মরিশাসে প্রথম চুক্তিবদ্ধ শ্রমিকদের নিয়ে আসে। এই দিনটি বর্তমানে মরিশাসে ‘আপ্রবাসী দিবস’ হিসেবে পালিত হয়। ভারতীয় অভিবাসীদের মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশই শেষ পর্যন্ত মরিশাসকেই স্থায়ী আবাস হিসেবে বেছে নেন। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে দুই দেশই স্বাধীনতা সংগ্রামে একে অপরকে সহায়তা করেছিল।
মরিশাসের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ও স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতা সেওসাগুর রামগোলাম মহাত্মা গান্ধী ও নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর ঘনিষ্ঠ ছিলেন। তিনি বসুর লেখা ‘The Indian Struggle’ বইটির প্রুফ রিডিংও করেছিলেন।
ভারতের কৌশলগত স্বার্থ ও মরিশাসের গুরুত্ব
মরিশাসে মোদী বলেন, “মরিশাস আমাদের গুরুত্বপূর্ণ সামুদ্রিক প্রতিবেশী এবং ভারত মহাসাগরের অন্যতম প্রধান অংশীদার”। তিনি আরও বলেন, “আমরা সাংস্কৃতিক বন্ধনে আবদ্ধ। এই সফর আমাদের সম্পর্ক আরও মজবুত করবে”। মরিশাসের পশ্চিম ভারত মহাসাগরে অবস্থান কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, চীনের প্রভাব বাড়ার ফলে এই অঞ্চলে সামুদ্রিক নিরাপত্তার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
ভারত মরিশাসের সামরিক সক্ষমতা বাড়াতে সহায়তা করেছে, বিশেষ করে এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জোন (EEZ) নজরদারি ও যৌথ সামরিক মহড়ায়। মালদ্বীপ চীনের দিকে ঝুঁকতে থাকায়, মরিশাস এখন ভারতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত অংশীদার হয়ে উঠেছে। ভারত অগালাগা দ্বীপে বিমানবন্দর ও নৌ-সুবিধা উন্নত করছে, যা মরিশাসের নিরাপত্তা বাড়ানোর পাশাপাশি ভারতের সামুদ্রিক উপস্থিতি দৃঢ় করবে। অগালাগা দ্বীপটি মরিশাস থেকে ১১০০ কিমি উত্তরে, ভারতের দক্ষিণ উপকূলের কাছাকাছি।
২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে ভারত ও মরিশাস যৌথভাবে একটি বিমানপথ এবং জেটি উদ্বোধন করে। মরিশাসের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী প্রবীণ জুগনাউথ ভারতের সামরিক ঘাঁটি নিয়ে উদ্বেগ উড়িয়ে দেন এবং বলেন, “মরিশাসের সার্বভৌমত্ব নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই”। ২০১৫ সালে, যখন মোদী প্রথম মরিশাস সফর করেন, তখন তিনি ভারত মহাসাগরে ‘SAGAR’ (Security and Growth for All) নীতি পুনর্ব্যক্ত করেন।
ভারত-মরিশাস অর্থনৈতিক সম্পর্ক
মরিশাস বহুদিন ধরেই ভারত ও আফ্রিকার মধ্যে একটি অর্থনৈতিক প্রবেশদ্বার হিসেবে কাজ করছে। এর রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং কর-সহায়ক নীতি বিনিয়োগের জন্য সুবিধাজনক পরিবেশ তৈরি করেছে। ভারত ও মরিশাসের মধ্যে Comprehensive Economic Cooperation and Partnership Agreement (CECPA) বাণিজ্য ও বিনিয়োগ প্রবাহকে আরও শক্তিশালী করেছে। ভারতীয় কোম্পানিগুলো মরিশাসে বিনিয়োগ ও ব্যবসা করছে, বিশেষ করে আর্থিক পরিষেবা, তথ্যপ্রযুক্তি, ওষুধ এবং বস্ত্র খাতে।
মরিশাস ভারতের অন্যতম বৃহত্তম বৈদেশিক বিনিয়োগ উৎস, যদিও সাম্প্রতিক কর সংস্কারের ফলে কিছু সুবিধা কমেছে। তবুও এটি এখনও ভারতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক কেন্দ্র। ২০২২-২৩ অর্থবর্ষে ভারত-মরিশাস বাণিজ্য ৫৫৪ মিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে।
আরও পড়ুন: Elon Musk: এক্স-এর পরিষেবা বিঘ্নিত হওয়ার জন্য সাইবার আক্রমণকে দায়ী করলেন ইলন মাস্ক
ভারত মরিশাসের উন্নয়ন প্রকল্পগুলিতেও অংশীদার হয়েছে। ভারত মেট্রো এক্সপ্রেস, ENT হাসপাতাল এবং সামাজিক গৃহ প্রকল্পের জন্য অনুদান ও ঋণ সহায়তা দিয়েছে। ভারতের ডিজিটাল গভর্ন্যান্স অভিজ্ঞতা মরিশাসের ই-গভর্ন্যান্স ব্যবস্থাকে আরও উন্নত করেছে।
আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক সহযোগিতা
আন্তর্জাতিক মঞ্চেও ভারত ও মরিশাস একে অপরকে সমর্থন করে। ভারত চাগোস দ্বীপপুঞ্জের উপর মরিশাসের সার্বভৌমত্বের দাবিকে সমর্থন করেছে। ১৯৬৫ সালে ব্রিটেন মরিশাসের স্বাধীনতার আগে চাগোস দ্বীপপুঞ্জ আলাদা করে নিয়েছিল, যা জাতিসংঘের উপনিবেশ-বিরোধী নীতির পরিপন্থী ছিল। ২০১৯ সালে আন্তর্জাতিক ন্যায় আদালত রায় দেয় যে, ব্রিটেনের চাগোসের নিয়ন্ত্রণ বেআইনি এবং এটি মরিশাসকে ফেরত দেওয়া উচিত। ভারত এই বিষয়টি নিয়ে বরাবর মরিশাসকে সমর্থন করেছে, যা মোদীর সফরের সময়ও পুনরায় নিশ্চিত করা হয়। ভারতের জন্য চাগোস গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি কৌশলগত নিরাপত্তার সঙ্গে সম্পর্কিত।
এছাড়া, চাগোসের দিয়েগো গার্সিয়া দ্বীপে একটি বিশাল মার্কিন সামরিক ঘাঁটি রয়েছে, যা মধ্যপ্রাচ্য ও এশিয়ায় সামরিক অভিযান চালানোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ভারতের সমর্থন চীনের বাড়তে থাকা উপস্থিতির মোকাবিলায় এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা রক্ষায় সহায়ক ভূমিকা রাখে। ভারতীয় বংশোদ্ভূত মানুষের সংখ্যার কারণে মরিশাসকে “মিনি ইন্ডিয়া” বলা হয়। ঐতিহাসিক সম্পর্ক ও কৌশলগত সহযোগিতার কারণে মরিশাস ভারতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।