ট্রাইব টিভি বাংলা ডিজিটাল :স্বামী বিবেকানন্দ,(Swami Vivekananda) ‘ভারতের গৌরব’ তাঁর জীবনযাত্রা এবং কর্মকাণ্ড শুধুমাত্র ভারতবর্ষে নয়, পৃথিবীজুড়ে একটি দৃষ্টান্ত। তাঁর শিকাগো যাত্রা, বিশেষ করে ১৮৯৩ সালে অনুষ্ঠিত বিশ্ব ধর্ম সম্মেলনে অংশগ্রহণ, ভারতীয় ধর্ম এবং দর্শনকে পশ্চিম বিশ্বের কাছে পরিচিত করানোর এক অসাধারণ সুযোগ তৈরি করেছিল। (Swami Vivekanandaকিন্তু এই যাত্রার পেছনে ছিল এক দীর্ঘ সংগ্রাম, আত্মবিশ্বাস এবং সহযাত্রীদের অবদান।
সন্ন্যাস গ্রহণ ও সমাজের বিরোধিতা (Swami Vivekananda)
স্বামী বিবেকানন্দ, যিনি জন্মসূত্রে কায়স্থ ছিলেন, সন্ন্যাস গ্রহণের পর সমাজের বিভিন্ন স্তরের তীব্র বিরোধিতার সম্মুখীন হন। কলকাতার রক্ষণশীল সমাজ, সনাতন হিন্দু সমাজ এবং এমনকি বাংলার সাধুসমাজও তাঁর এই সিদ্ধান্তকে ভালো চোখে নেয়নি। তবে, বিবেকানন্দ ছিলেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। ১৮৮১ সালে রামকৃষ্ণ পরমহংসের সঙ্গে পরিচয়ের পর, তিনি ধীরে ধীরে তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন এবং ‘নরেন্দ্রনাথ’ (Narendranath) থেকে ‘স্বামী বিবেকানন্দ’ হয়ে ওঠেন। (Swami Vivekananda)এই পরিবর্তন শুধু তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের নয়, বরং গোটা বাংলার ধর্মীয় এবং সামাজিক ইতিহাসের এক নতুন মোড়ের সূচনা ঘটায়।
মাদ্রাজে আলাসিংগা পেরুমলের(Alasinga Perumal )সাথে পরিচয় (Swami Vivekananda)
১৮৮৮-১৮৯৩ সাল পর্যন্ত স্বামী বিবেকানন্দ রামকৃষ্ণ পরমহংসের বাণী বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেন। মাদ্রাজে (বর্তমানে চেন্নাই) এক স্কুল শিক্ষক আলাসিংগা পেরুমলের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটে। (Swami Vivekananda) আলাসিংগা পেরুমল ছিলেন একজন ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি, যিনি শিকাগো বিশ্ব ধর্ম সম্মেলনে হিন্দু ধর্মের প্রতিনিধিত্ব করতে একজন বক্তাকে খুঁজছিলেন। তিনি স্বামী বিবেকানন্দকে বুঝতে পারলেন এবং তাঁকে শিকাগো যাওয়ার প্রস্তাব দিলেন। যদিও প্রথমবারে অর্থের অভাবে প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছিল, কিন্তু দ্বিতীয়বার প্রচেষ্টায় অনেক মানুষের সাহায্যে এবং বিশেষ করে মাইসোরের মহারাজ, হায়দরাবাদের নবাবদের আর্থিক সহায়তায় স্বামীজি শিকাগো যাত্রার প্রস্তুতি নেন।
শিকাগো যাত্রা
স্বামী বিবেকানন্দ যখন শিকাগো পৌঁছন, তখন তাঁর সামনে নানা সমস্যার পাহাড় দাঁড়িয়ে ছিল। অর্থের অভাব, শীতের পোশাকের অভাব, এবং সম্মেলনে যোগ দেওয়ার জন্য রেজিস্ট্রেশন না থাকার কারণে তিনি প্রথমে হতাশ হন। একসময় রেলস্টেশনে রাত কাটানোর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। তবে আলাসিংগা পেরুমল তাঁর কাছে কিছু টাকা পাঠিয়ে দেন। এর পর, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জন হেনরি রাইট স্বামী বিবেকানন্দের সঙ্গে দেখা করেন এবং তাঁকে সম্মেলনে যোগ দেওয়ার ব্যবস্থা করেন।
শিকাগো ধর্ম সম্মেলনে স্বামী বিবেকানন্দের বক্তৃতা
১৮৯৩ সালের ১১ সেপ্টেম্বর শিকাগোতে বিশ্ব ধর্ম সম্মেলন শুরু হয়।( World Conference of Religions began in Chicago )সম্মেলনের প্রথম দিনেই, অন্যান্য বক্তাদের পর, স্বামী বিবেকানন্দকে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য আহ্বান জানানো হয়। তিনি যখন ‘সিস্টার্স অ্যান্ড ব্রাদার্স অফ আমেরিকা’ বলে বক্তৃতা শুরু করেন, তখন উপস্থিত সাত হাজার শ্রোতা দাঁড়িয়ে সম্মান জানান। তাঁর বক্তৃতার এই অমর মুহূর্তটি শুধু শিকাগো শহরকে নয়, পৃথিবীজুড়ে ভারতীয় সংস্কৃতি ও হিন্দু ধর্মকে এক নতুন পরিচিতি দেয়। স্বামী বিবেকানন্দের বক্তৃতা এতই প্রভাবশালী ছিল যে, এক রাতের মধ্যে তিনি শিকাগো শহরে খ্যাতি অর্জন করেন।
আরও পড়ুন:Generation Beta: ভারতে জন্মানো ‘জেনারেশন বিটা’র প্রথম শিশু মিজোরামের ফ্র্যাঙ্কি
শিকাগো সম্মেলন ও পরবর্তী জীবন
স্বামী বিবেকানন্দ শিকাগো সম্মেলনে পাঁচটি বক্তৃতা দেন এবং সম্মেলনের শেষে তাঁর বক্তৃতা নিয়ে একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়, যেখানে তাঁকে বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পণ্ডিত হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। এই সম্মেলন থেকে তাঁর যাত্রা শুরু হয়ে আমেরিকা ও ইউরোপের নানা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। ১৮৯৭ সালে তিনি আবার মাদ্রাজে ফিরে আসেন, যেখানে তাঁকে ‘ভগবান’ হিসেবে পূজিত করা হয়।
রাজপুতানার রাজা অজিত সিং এবং নতুন নাম
স্বামী বিবেকানন্দের শিকাগো যাত্রার পেছনে রাজপুতানার ক্ষেত্রী রাজা অজিত সিংয়ের অবদান ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি স্বামীজিকে ‘স্বামী বিবেকানন্দ’ নামটি দেন, যা পরবর্তী সময়ে বিশ্বব্যাপী পরিচিত হয়ে ওঠে। ফরাসি লেখক রোমেন রোল্যান্ড তাঁর বই ‘দ্য লাইফ অফ বিবেকানন্দ অ্যান্ড দ্য ইউনিভার্সাল গসপেল’-এ এই বিষয়টি উল্লেখ করেছেন।
স্বামী বিবেকানন্দের শিকাগো যাত্রা একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত, যা শুধু ভারতীয় ধর্ম এবং দর্শনকেই নয়, সমগ্র পৃথিবীকে প্রভাবিত করেছে। তাঁর সংগ্রাম, দুঃখ-কষ্ট এবং একাগ্রতা আজও আমাদের প্রেরণা যোগায়। তিনি যে মহামানব হয়ে ওঠেছিলেন, তা তাঁর অসীম আত্মবিশ্বাস, দেশপ্রেম এবং মানবকল্যাণের অদম্য ইচ্ছাশক্তির ফলস্বরূপ।