সঞ্জীব মল্লিক, বাঁকুড়া: সাড়ে ৩০০ বছরের প্রাচীন জমিদার বাড়ি। মুচিরাম ঘোষ থেকে মণ্ডল জমিদার হওয়ার ইতিহাস। রয়েছে দামু-কামুর জলদস্যুদের সঙ্গে যুদ্ধের কাহিনী। সবকিছুই জড়িয়ে হদল নারায়নপুর জমিদার বাড়ির ৩০০ বছরের প্রাচীন দুর্গাপূজোর ইতিহাসের সাথে।
আজ থেকে প্রায় ৩৫০ বছর আগে বর্ধমানের নীলপুর গ্রাম থেকে ভাগ্যের খোঁজে বেরিয়ে ছিলেন মুচিরাম ঘোষ। ঘুরতে ঘুরতে বাঁকুড়া জেলা পাত্রসায়ের থানার নারায়ণপুর বোদাই নদীর তীরে এসে তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। সেখানেই শুরু করেন বসতি। সাক্ষাৎ হয় সেখানকার বিশিষ্ট গণিত আচার্য শুভঙ্কর রায়ের সাথে। তখন মল্ল রাজাদের রাজত্বকাল। মল্ল রাজা ছিল গোপাল সিংহ। একদিন মুছিলাম ঘোষ শুভঙ্কর রায়ের সাথে গিয়ে বিষ্ণুপুরের মল্ল রাজাদের সান্নিধ্য লাভ করেন। মুচিরাম ঘোষের ব্যবহারে এবং তার কার্যকলাপে খুশি হন মল্ল রাজা গোপাল সিংহ।
মল্ল রাজাদের দাক্ষিণ্যেই দামোদরের উপনদী বোদাই-য়ের তীরে বিশাল এলাকার জমিদারী লাভ করেন মুচিরাম ঘোষ। বাঁকুড়ার হদল ও নারায়ানপুর গ্রামের মাঝে বিশাল জমিদারবাড়ির প্রাসাদ তৈরি হয়। আরও পরে ব্রিটিশদের কাছ থেকে ওই এলাকার মোট ৭ টি নীলকুঠী ইজারা নিয়ে নেয় মণ্ডলরা। কথিত আছে সে সময় বোদাই নদীতে নীল বোঝাই করা বজরা ভাসিয়ে দূর দুরান্তে তা রপ্তানি করত মণ্ডলরা। সে সময় নীল বিক্রি করে প্রচুর ধন সম্পদ নিয়ে বজরায় করে গ্রামে ফেরার সময় কোন এক যায়গায় জল দস্যুদের কবলে পড়েছিল মণ্ডল বাড়ির কোন এক পূর্বপুরুষ।
দামু-কামুর জলদস্যুদের সঙ্গে যুদ্ধের কাহিনী
সেই সময় ওই জমিদারের সাথে ছিল দুই লাঠিয়াল দাম ও কামু। হঠাৎ করেই জমিদারের বজরায় হানা দেয় জল দস্যুরা। সর্বোচ্চ লুট হয়ে যাওয়ার ভয়ে অসহায় হয়ে পড়েছিলেন জমিদার। তখন জল দস্যুদের সঙ্গে নিজেদের জীবন বাজি রেখে লড়াই করেছিলেন দামু ও কামু। জমিদার ফিরে পেয়েছিলেন তার সমস্ত সম্পত্তি, ফিরে পেয়েছিলেন প্রাণ। জল দস্যুর হাত থেকে বেঁচে ফিরলে বজরায় থাকা যাবতীয় সম্পত্তি মা দুর্গার নামে দেবত্তর করে দেওয়ার মানত করেন তিনি। পরে তিনি সুস্থ ভাবে ফিরে এলে ওই বজরায় থাকা সমস্ত ধন সম্পদ দিয়ে বিশাল দুর্গা দালান, রাস মঞ্চ, রথ মন্দির, নাট মন্দির, নহবত খানা তৈরি করেন। বংশ পরম্পরা পুজা চালিয়ে যাওয়ার জন্য বহু জমি ও পুকুর কিনে সেগুলি মা দুর্গার নামে দেবত্তর করে দেন।
এক দিকে নীল কুঠির বিপুল আয় অন্যদিকে বিশাল জমিদারির খাজনায় ফুলে ফেঁপে ওঠে রাজকোষ। তার প্রভাব পড়ে দুর্গাপুজাতেও। সে সময় পুজোয় সাতদিন ধরে নহবত খানায় বসত নহবত। দুর্গা মন্দির সহ সমস্ত মন্দির সাজানো হত বেলজিয়াম গ্লাসের বিশাল বিশাল সেজের ঝাড়বাতিতে। পুজার সময় বসত পুতুল নাচের আসর, হত যাত্রাপালা। দুর্গা পুজার প্রতিটি নির্ঘণ্ট ঘোষিত হত তোপ ধ্বনির দ্বারা। দূর দূরান্তের মানুষ ও প্রজারা হাজির হতেন জমিদারবাড়িতে।
আজ আর সেই নীল কুঠিও নেই, নেই জমিদারীও। তবু বিশাল দেবত্তর এস্টেট এর আয়ে দুর্গা পুজোয় আয়োজনের ত্রুটি রাখেন না মণ্ডল বাড়ির বর্তমান প্রজন্ম। আজও পুজো এলেই মণ্ডল জমিদারবাড়ীর নহবত খানা থেকে বেজে ওঠে সানাইয়ের সুর। ভাঁড়ার থেকে পুরানো দিনের সেই ঝাড়বাতি বার করে, তার ধুলো ঝেড়ে দুর্গাপুজোর সময় টাঙানো হয় দর দালানের বিভিন্ন প্রান্তে। দেশ বিদেশে ছড়িয়ে থাকা পরিবারের সদস্যরা আজও পুজোর সময় ছুটে আসে, শুধু ইতিহাসকে ছুঁয়ে দেখার লোভে।