ট্রাইব টিভি বাংলা ডিজিটাল: ১৯৭৫ সালের ৩০ এপ্রিল শেষ হয় ভিয়েতনাম যুদ্ধ (50 Years of Vietnam War)। লজ্জাজনক হারের মাধ্যমে ভিয়েতনাম ছাড়তে বাধ্য হয় আমেরিকা। ২০২৫ সালে সেই জয়ের ৫০ বছর উদযাপন হচ্ছে ভিয়েতনামে।
দুই ভিয়েতনামের পুনর্মিলনের ৫০ বছর উদযাপন (50 Years of Vietnam War)
১৯৭৫ সালের ৩০ এপ্রিল, দক্ষিণ ভিয়েতনামের রাজধানী সায়গন (বর্তমানে হো চি মিন সিটি) কমিউনিস্ট বাহিনীর দখলে আসে (50 Years of Vietnam War)। দীর্ঘ দিন ধরে চলা ভিয়েতনাম যুদ্ধের পর, এই ঘটনায় অ্যামেরিকার নেতৃত্বাধীন লড়াই শেষ হয় অপমানজনকভাবে। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরেই শুরু হয় দেশের সংযুক্তির প্রক্রিয়া, যেটি আজ ভিয়েতনামে “জাতীয় একীকরণ দিবস” হিসেবে উদযাপন করা হয়।
২০২৫ সালের ৩০ এপ্রিল, দক্ষিণ মুক্তি এবং জাতীয় পুনর্মিলনের ৫০তম বার্ষিকীতে হো চি মিন শহরের জেলা ১-এর লে ডুয়ান বুলেভার্ডে বিশাল সামরিক কুচকাওয়াজ ও সাধারণ মানুষের পদযাত্রার মাধ্যমে দিনটি উদযাপন করা হয় (২০২৫ সালের ৩০ এপ্রিল, দক্ষিণ মুক্তি এবং জাতীয় পুনর্মিলনের ৫০তম বার্ষিকীতে হো চি মিন শহরের জেলা ১-এর লে ডুয়ান বুলেভার্ডে বিশাল সামরিক কুচকাওয়াজ ও সাধারণ মানুষের পদযাত্রার মাধ্যমে দিনটি উদযাপন করা হয় (50 Years of Vietnam War)।
সামরিক কুচকাওয়াজে ভিয়েতনামের শক্তি প্রদর্শন (50 Years of Vietnam War)
মি-৮টি, মি-১৭, মি-১৭১ হেলিকপ্টার এবং ভিয়েতনাম পিপলস আর্মির ফাইটার প্লেন জাতীয় পতাকা ও কমিউনিস্ট পার্টির পতাকা নিয়ে আকাশে উড়ে প্রদর্শনী শুরু করে। এছাড়াও অংশ নেয় সু-৩০এমকে২ এবং ইয়াক-১৩০ যুদ্ধবিমান। চীন, লাওস এবং কম্বোডিয়ার সেনা দলও কুচকাওয়াজে অংশগ্রহণ করে। এই দেশগুলো ভিয়েতনামের স্বাধীনতা আন্দোলন এবং জাতীয় নিরাপত্তায় ঐতিহাসিকভাবে সহায়ক ছিল।
এই কুচকাওয়াজ স্মরণ করায় সেই দিনটি, যখন উত্তর ভিয়েতনামের কমিউনিস্ট সেনারা (সোভিয়েত রাশিয়া ও চীনের সমর্থনে) সায়গনের ইন্ডিপেনডেন্স প্যালেস দখল করে। প্রায় দুই দশক ধরে চলা যুদ্ধের শেষ হয় সেইদিন। এই সংঘাতে উত্তর ও দক্ষিণ উভয় ভিয়েতনাম এবং দক্ষিণকে সমর্থন করা আমেরিকা প্রচণ্ড ক্ষতির মুখে পড়ে।
আমেরিকা ও ভিয়েতনামের বর্তমান সম্পর্ক (50 Years of Vietnam War)
যুদ্ধ শেষে দুই দেশের সম্পর্ক ধীরে ধীরে উন্নত হয়েছে (50 Years of Vietnam War)। বর্তমানে ভিয়েতনাম ও আমেরিকা একটি ‘কমপ্রিহেনসিভ স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারশিপ’-এ স্বাক্ষর করেছে। এটি দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতার দৃঢ়তা এবং সম্পর্কের উন্নতির প্রমাণ।
আরও পড়ুন: India US Trade Deal: ভারত-আমেরিকা বাণিজ্যচুক্তি, নতুন দিগন্তের দিকে সম্পর্ক!
ভিয়েতনাম যুদ্ধের সূচনা (50 Years of Vietnam War)
এই যুদ্ধ শুরু হয় ১৯৫৫ সালে (50 Years of Vietnam War)। একদিকে ছিল উত্তর ভিয়েতনাম, যাদের সমর্থন করত সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীন। অন্যদিকে ছিল পশ্চিমসমর্থিত দক্ষিণ ভিয়েতনাম। ভিয়েতনাম আগে ফরাসি উপনিবেশ ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে জাপান এর দখল নেয়। যুদ্ধ শেষ হলে ক্ষমতার শূন্যতা তৈরি হয় এখানে। ফরাসিরা আবার ফিরে এসে দখল নিতে চাইলেও হো চি মিনের নেতৃত্বে কমিউনিস্ট বিপ্লবীরা তাঁদের প্রতিহত করে।
১৯৪৫ সালের সেপ্টেম্বরে হো চি মিন উত্তর ভিয়েতনামের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং ‘ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব ভিয়েতনাম’ প্রতিষ্ঠা করেন। ফরাসিরা এই ঘোষণাকে আংশিক স্বীকৃতি দিলেও হো চি মিন পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি থেকে সরেননি। এরপরেই শুরু হয় গেরিলা যুদ্ধ।
বিশ্ব রাজনীতির পরিবর্তন ও যুদ্ধের প্রসার
১৯৪৭ সালে অ্যামেরিকার প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান কমিউনিজমের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। ১৯৫০ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীন উত্তর ভিয়েতনামকে স্বীকৃতি দেয়। আমেরিকা একে হুমকি হিসেবে দেখে এবং ফরাসিদের সাহায্য বাড়ায়। ১৯৫৪ সালে জেনেভা চুক্তির মাধ্যমে ভিয়েতনামকে ১৭তম অক্ষাংশ ধরে দুই ভাগে ভাগ করা হয়। উত্তরে হো চি মিন, দক্ষিণে এন গো দিন দিয়েম। দুই বছরের মধ্যে নির্বাচন ও পুনর্মিলনের শর্ত ছিল, কিন্তু তা বাস্তবায়িত হয়নি।
১৯৫৯ সাল থেকে উত্তর বাহিনী লাওস ও কম্বোডিয়ার মধ্য দিয়ে ‘হো চি মিন ট্রেইল’ নামে রসদ সরবরাহ পথ বানিয়ে দক্ষিণে গেরিলা আক্রমণ শুরু করে। এনএলএফ নামে একটি রাজনৈতিক শাখা গঠিত হয় দক্ষিণে, যা পরবর্তীতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ‘ভিয়েত কং’ নামে পরিচিত করে তোলে। ১৯৬৩ সালের মধ্যে ৪০,০০০ সেনা দক্ষিণে গোপনে পাঠানো হয়। এতে আমেরিকা ক্রুদ্ধ হয়ে গোপনে নিজেদের সেনা পাঠাতে শুরু করে।
অ্যামেরিকার জড়িয়ে পড়া ও যুদ্ধের বিস্তার
১৯৬৩ সালে আমেরিকা দক্ষিণ নেতা দিয়েমকে হটিয়ে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটায়। ১৯৬৩ থেকে ১৯৬৫ সালের মধ্যে ১২টি সরকার আসে। ১৯৬৪ সালে ‘গালফ অব টনকিন’ ঘটনার পর, অ্যামেরিকার কংগ্রেস একটি প্রস্তাব পাশ করে যাতে প্রেসিডেন্ট যেকোনও প্রয়োজনীয় সামরিক ব্যবস্থা নিতে পারেন। ৯৬৫ সালে আমেরিকা যুদ্ধ শুরু করে বোমাবর্ষণ দিয়ে। এরপর এক দশক ধরে চলা এই যুদ্ধে আমেরিকার “অজেয়” ভাবমূর্তি চূর্ণ হয়।
১৯৬৮ সালে টেট আক্রমণ: যুদ্ধের মোড় ঘোরানো মুহূর্ত
১৯৬৮ সালের জানুয়ারিতে ‘টেট’ উৎসব চলাকালে উত্তর বাহিনী ও ভিয়েত কং দক্ষিণ ও আমেরিকান ঘাঁটিতে হঠাৎ আক্রমণ চালায়। সামরিকভাবে এটি ব্যর্থ হলেও আমেরিকার জনগণের মধ্যে এই ঘটনা যুদ্ধবিরোধী মনোভাব তৈরি করে। প্যারিসে শান্তি আলোচনা শুরু হয়, কিন্তু দক্ষিণ ভিয়েতনামের প্রেসিডেন্ট থিউ এই চুক্তি মানেননি। এরপর মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সন হুমকি দেন। ‘লাইনব্যাকার-২’ নামে বড় আকারের বিমান হামলা হয় ১৯৭২ সালের ডিসেম্বরে। এতে মার্কিন বাহিনীরও ব্যাপক ক্ষতি হয়।
১০ দিন পর, জানুয়ারি ৮, ১৯৭৩-এ শান্তি আলোচনা আবার শুরু হয় এবং জানুয়ারি ২৭ তারিখে চার পক্ষ মিলে ‘প্যারিস শান্তি চুক্তি’ স্বাক্ষর করে। এর ফলে আমেরিকা যুদ্ধ থেকে নিজেদের গুটিয়ে নেয়।
সায়গনের পতন: যুদ্ধের পরিসমাপ্তি
১৯৭৫ সালের মার্চে উত্তর বাহিনী কুয়াং ত্রি ও সেন্ট্রাল হাইল্যান্ডস আক্রমণ শুরু করে। দক্ষিণের প্রতিরোধ ভেঙে পড়ে। প্রেসিডেন্ট থিউ অভিযোগ করেন, আমেরিকা দক্ষিণ ভিয়েতনামকে একা ফেলে পালিয়েছে এবং তিনি ২১ এপ্রিল পদত্যাগ করেন। ২৭ এপ্রিল, এক লক্ষ উত্তর ভিয়েতনামি সৈন্য সায়গন ঘিরে ফেলে। ২৯ এপ্রিল রাত থেকে আমেরিকান দূতাবাস থেকে হেলিকপ্টারে ৭,০০০ জনের বেশি মানুষকে সরানো হয়। ৩০ এপ্রিল দুপুরে, একটি টি-৫৪ ট্যাংক প্রেসিডেন্ট প্যালেসে ঢুকে পতাকা তোলে। এর মাধ্যমেই দক্ষিণ ভিয়েতনামের পতন ঘটে এবং দীর্ঘ, রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের ইতি হয়।
এক যুদ্ধের শেষ, আরেক অধ্যায়ের শুরু
এই যুদ্ধ আমেরিকার ইতিহাসে একটি ব্যয়বহুল ও বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতা। কিন্তু ভিয়েতনামের জন্য এটি ছিল নতুন সংযুক্ত, কমিউনিস্ট যুগের সূচনা।