ট্রাইব টিভি বাংলা ডিজিটাল: জীবনানন্দ দাশ(Jibanananda Dash) বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রধান আধুনিক বাঙালি কবি, লেখক ও প্রাবন্ধিক। বুদ্ধদেব বসু তাঁকে ‘নির্জনতম কবি’ বলে আখ্যায়িত করেছেন৷ অন্যদিকে, অন্নদাশঙ্কর রায় তাঁকে ‘শুদ্ধতম কবি’ অভিধায় আখ্যায়িত করেছেন। জীবনানন্দের কাব্যে হয়ে উঠেছে চিত্ররূপময়, তাতে তিনি ‘রূপসী বাংলার কবি’ অভিধায় খ্যাত হয়েছেন সব থেকে বেশি৷ তবে নির্জনতা, নৈসর্গিকতায় তাঁর কবিতাতে বেশি লক্ষ্য করা যায়। যেমন ‘আট বছর আগের এক দিন’ কবিতা থেকে- “অর্থ নয়, কীর্তি নয়, সচ্ছলতা নয়,আরো-এক বিপন্ন বিস্ময়, আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে খেলা করে; আমাদের ক্লান্ত করে, ক্লান্ত— ক্লান্ত করে; লাসকাটা ঘরে সেই ক্লান্তি নাই।”
জন্ম (Jibanananda Dash)
জীবনানন্দ দাশ(Jibanananda Dash) ১৮৯৯ সালের এই দিনে বরিশাল শহরে জন্মগ্রহণ করেন। জীবনানন্দ ছিলেন পিতামাতার জ্যেষ্ঠ সন্তান; তার ডাকনাম ছিল মিলু৷ তাঁর পূর্বপুরুষেরা ছিলেন মুন্সীগঞ্জ জেলার বিক্রমপুর পরগনা নিবাসী। তাঁর মা কবি কুসুম কুমারী দাশ ও পিতা সত্যনানন্দ দাশ। তাঁর পিতামহ সর্বানন্দ দাশগুপ্ত (১৮৩৮-৮৫) বিক্রমপুর থেকে বরিশালে নিবাস স্থানান্তরিত করেন। সর্বানন্দ দাশগুপ্ত জন্মসূত্রে হিন্দু ছিলেন; পরে ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষা নেন। তিনি বরিশালে ব্রাহ্ম সমাজ আন্দোলনের প্রাথমিক পর্যায়ে অংশগ্রহণ করেন।
উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ (Jibanananda Dash)
জীবনানন্দ দাশ কল্লোল পত্রিকায় ‘নীলিমা’ কবিতাটি প্রকাশিত হওয়ার মধ্যে দিয়েই প্রথম পরিচিতি লাভ করেন। কবিতাটি অনেক তরুণ কাব্যরসিকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তার উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ হচ্ছে- ঝরা পালক (প্রকাশের কাল ১৯২৭) ধূসর পাণ্ডুলিপি (১৯৩৬), বনলতা সেন-(১৯৪২)। বনলতা সেন কাব্যগ্রন্থের কবিতা সমূহ পরবর্তীতে কবিতা গ্রন্থ মহাপৃথিবী (১৯৪৪) এ প্রকাশিত হয়। জীবনানন্দের(Jibanananda Dash) জীবদ্দশায় সর্বশেষ প্রকাশিত গ্রন্থ ‘সাতটি তারার তিমির’ (১৯৪৮)। ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুর কিছু আগে প্রকাশিত হয় জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা। কলকাতা, ঢাকা এবং অন্যান্য জায়গার বিভিন্ন সাহিত্যপত্রিকায় তার লেখা ছাপা হতে থাকে; যেগুলোর মধ্যে ছিল সে সময়কার সুবিখ্যাত পত্রিকা কল্লোল, কালিকলম, প্রগতি প্রভৃতি৷
আরও পড়ুন: Jibanananda Das Birthday: জন্মদিনে বরিশালের মানুষ কীভাবে স্মরণ করলেন কবি জীবনানন্দ দাশকে?
জীবদ্দশায় কথাসাহিত্যিক হিসাবে পরিচিতি ছিল না
জীবদ্দশায় কথাসাহিত্যিক হিসাবে জীবনানন্দের কোনোও পরিচিতি ছিল না(Jibanananda Dash)। ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দ অবধি প্রকাশিত তার রচিত উপন্যাসের সংখ্যা ২১ এবং ছোটগল্পের সংখ্যা শতাধিক। তিনি সম্পূর্ণ নিভৃতে উপন্যাস-ছোটগল্প লিখেছিলেন এবং জীবদ্দশায় একটিও প্রকাশ করে যাননি। তার মৃত্যুর পর উপন্যাস-গল্পের পাণ্ডুলিপির খাতাগুলো আবিষ্কৃত হয়। এগুলোর প্রথম সংকলন জীবনানন্দ দাশের গল্প (১৯৭২)। বেশ কিছুকাল পর প্রকাশিত হয় জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ গল্প (১৯৮৯)। পরবর্তীকালে আবদুল মান্নান সৈয়দ জীবনানন্দ দাশের পত্রাবলি প্রকাশ করেন ১৯৮৬ সালে। ১০১টি চিঠির সংকলন জীবনানন্দ দাশের চিঠিপত্র প্রকাশিত হয় ২০১৪ খ্রিস্টাব্দে।
প্রাবন্ধিক জীবনানন্দ
তিনি লিখেছিলেন অজস্র প্রবন্ধ। তার মধ্যে বুদ্ধদেব বসু কবিতা পত্রিকার একটি প্রবন্ধ সংখ্যার (১৩৪৫, বৈশাখ) পরিকল্পনা করেছিলেন মূলত কবিদের গদ্য প্রকাশের উদ্দেশ্য নিয়ে। এরই সূত্রে জীবনানন্দ তার প্রথম গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধটি লিখেছিলেন যার নাম ‘কবিতার কথা’। সেই প্রবন্ধেই রয়েছে সেই বিখ্যাত লাইন, “সকলেই কবি নন, কেউ কেউ কবি”। তার প্রবন্ধ সংকলন কবিতার কথা বেরিয়েছিল তার মৃত্যুর পর – বঙ্গাব্দ ১৩৬২ তে । এতে তার জীবদ্দশায় বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় মুদ্রিত পনেরটি প্রবন্ধ সংকলিত হয়েছিল।
মৃত্যু পর প্রকাশিত গ্রন্থসমূহ
কবির মৃত্যু পরবর্তী প্রকাশিত গ্রন্থসমূহ হলো- প্রকাশিত রূপসী বাংলা (১৯৫৭) এবং ১৯৬১ তে প্রকাশিত হয় বেলা অবেলা কালবেলা। তাঁর অগ্রন্থিত কবিতাবলি নিয়ে প্রকাশিত কবিতা সংকলনগুলো হলো—সুদর্শনা (১৯৭৩), আলো পৃথিবী (১৯৮১), মনোবিহঙ্গম, হে প্রেম তোমার কথা ভেবে (১৯৯৮) অপ্রকাশিত একান্ন (১৯৯৯) এবং আবছায়া (২০০৪)।
কর্মজীবন
জীবনানন্দ দাশ অধ্যাপনা করেছেন বর্তমান বাংলাদেশ ও ভারতের অনেকগুলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, যার মধ্যে আছে সিটি কলেজ, কলকাতা (১৯২২-১৯২৮), বাগেরহাট কলেজ, খুলনা (১৯২৯); রামযশ কলেজ, দিল্লী (১৯৩০-১৯৩১), ব্রজমোহন কলেজ, বরিশাল (১৯৩৫-১৯৪৮), খড়গপুর কলেজ (১৯৫১-১৯৫২), বড়িশা কলেজ (অধুনা ‘বিবেকানন্দ কলেজ’, কলকাতা) (১৯৫৩) এবং হাওড়া গার্লস কলেজ, কলকাতা (১৯৫৩-১৯৫৪) তার কর্মজীবন আদৌ মসৃণ ছিল না বলেই আমরা জানি।
পুরস্কার ও স্বীকৃতি
জীবনানন্দ দাশ ১৯৫৫ সালে ভারত সরকারের সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন যা ছিল তাঁর মৃত্যুর পর। এর আগে, ১৯৫২ সালে নিখিলবঙ্গ রবীন্দ্রসাহিত্য সম্মেলন পরিবর্ধিত সিগনেট সংস্করণ বনলতা সেন কাব্যগ্রন্থটি বাংলা ১৩৫৯-এর শ্রেষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ বিবেচনায় পুরস্কৃত করা হয়। এই বিখ্যাত কবি জীবনানন্দ কলকাতায় ট্রাম দুর্ঘটনায় আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৯৫৪ সালের ২২ অক্টোবর মারা যান। জীবনানন্দের লেখায় রয়েছে এক ধরনের বিষাদ, ক্লান্তির মদিরতা। যেন সময় তাঁর কবিতায় অত্যন্ত ধীর গতিতে বহমান। আজও সেই বহমানতা পাঠক মনে।