ট্রাইব টিভি বাংলা ডিজিটাল: ট্রাম্পের নতুন শুল্কের পর চীনের পাল্টা আঘাত (US-China Tariff War)। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প চীনা পণ্যের উপর ১০ শতাংশ শুল্ক চাপানোর কথা ঘোষণা করার পরপরই চীনও পাল্টা ব্যবস্থা নিয়েছে।
মার্কিন কয়লা এবং তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (LNG) উপর ১৫ শতাংশ শুল্ক এবং মার্কিন তেল ও কৃষি যন্ত্রপাতির উপর ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে চীন। শুধু তাই নয়, গুগলের বিরুদ্ধে একটি অ্যান্টিট্রাস্ট তদন্তও শুরু করেছে চীন (US-China Tariff War)।
চীনের রাষ্ট্রীয় বাজার নিয়ন্ত্রণ প্রশাসন (State Administration for Market Regulation) মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে জানায়, তারা গুগলের বিরুদ্ধে প্রতিযোগিতা আইন লঙ্ঘনের অভিযোগের তদন্ত শুরু করছে।
মার্কিন সংস্থাগুলোর ওপর নিষেধাজ্ঞা (US-China Tariff War)
চীন ক্যালভিন ক্লেইনের মালিক PVH Corp. এবং মার্কিন জিন সিকোয়েন্সিং সংস্থা Illumina Inc.-কে একটি বিশেষ কালো তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে (US-China Tariff War)। এছাড়াও, টাংস্টেন-সংক্রান্ত রপ্তানির উপর নতুন নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে চীন।
চীনের অর্থ মন্ত্রক এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, “আমেরিকার একতরফা শুল্ক আরোপ বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (WTO) নিয়মের চরম লঙ্ঘন। এটি শুধু আমেরিকার নিজেদের সমস্যার সমাধান করতে ব্যর্থই হবে না, বরং চীন-আমেরিকার স্বাভাবিক বাণিজ্যিক সম্পর্কেও প্রভাব ফেলবে।”
শি জিনপিংয়ের কৌশলী প্রতিক্রিয়া (US-China Tariff War)
চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এমনভাবে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন, যাতে চীনের অর্থনীতিতে বড় ধরনের প্রভাব না পড়ে, কিন্তু ট্রাম্পকে শক্ত বার্তাও দেওয়া যায় (US-China Tariff War)।
বিশেষজ্ঞদের মতে, শি জিনপিং মার্কিন গুরুত্বপূর্ণ খনিজ সরবরাহ ব্যবস্থায় বিঘ্ন ঘটানোর চেষ্টা করছেন, আবার মার্কিন সংস্থাগুলোর ওপর চাপও সৃষ্টি করছেন। তবে এই পাল্টা প্রতিক্রিয়া তুলনামূলকভাবে সংযত ছিল (US-China Tariff War)।
ট্রাম্প শুল্ক কার্যকর হওয়ার আগেই শি-এর সঙ্গে আলোচনার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন, যা বাজারে কিছুটা স্থিতিশীলতা এনেছিল। শুল্ক ঘোষণার পর ডলারের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে, অন্যদিকে অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের মুদ্রা প্রায় ১ শতাংশ কমে গিয়েছে।
“সংযত ও যথাযথ” প্রতিক্রিয়া বলছে বিশেষজ্ঞরা
সিঙ্গাপুরের নানইয়াং টেকনোলজিক্যাল ইউনিভার্সিটির রাজনীতি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডিলান লোহ বলেছেন, “চীনের প্রতিক্রিয়া সংযত এবং কৌশলগতভাবে সঠিক। এটি দেখাচ্ছে যে বেজিং পদক্ষেপ নিচ্ছে, কিন্তু তেমন কঠোর অবস্থান নিচ্ছে না, যা আরও পাল্টা প্রতিক্রিয়া ডেকে আনতে পারে।” তিনি আরও বলেন, “চীন, কানাডা ও মেক্সিকোর পদক্ষেপও পর্যবেক্ষণ করছে, এবং তারা জানে যে এখনো আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতায় পৌঁছানো সম্ভব।”
চীনের পাল্টা শুল্ক ও মার্কিন সংস্থাগুলোর ক্ষতি
চীন প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই পাল্টা শুল্ক আরোপ করেছে, যা ট্রাম্পের আলোচনার আশা শেষ করে দিয়েছে। ট্রাম্প এর আগে কানাডা ও মেক্সিকোকে ২৫ শতাংশ শুল্ক থেকে শেষ মুহূর্তে ছাড় দিয়েছিলেন, কিন্তু চীনের ক্ষেত্রে এমন কোনও ছাড় দেননি।
চীনে গত বছর মার্কিন তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (LNG) আমদানির হার ছিল ৬ শতাংশ। তবে চীন মার্কিন কয়লার উপর নির্ভরশীল নয়। গুগল ২০১০ সাল থেকে চীনে সার্চ ইঞ্জিন ও ইন্টারনেট পরিষেবা সরবরাহ করে না, তবে দেশটিতে বিজ্ঞাপন ব্যবসা পরিচালনা করছে।
“মার্কিন কোম্পানিগুলোর জন্য সতর্কবার্তা”
হংকং-এর ING ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ লিন সং বলেছেন, “এটি মার্কিন কোম্পানিগুলোর জন্য একটি সতর্কবার্তা। বিশেষ করে যারা চীনের বাজারের উপর বেশি নির্ভরশীল।” তিনি আরও বলেন, “আলোচনার মাধ্যমে এই শুল্ক বাতিল হতে পারে বা কার্যকর হওয়ার সময় পিছিয়ে দেওয়া যেতে পারে।”
চীনের টাংস্টেন রপ্তানি নিয়ন্ত্রণের প্রভাব
চীন বিশ্বে টাংস্টেন উৎপাদনে শীর্ষ দেশ, যা বিশ্বের ৮০ শতাংশ সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করে। টাংস্টেন উচ্চ ঘনত্ব ও উচ্চ গলনাঙ্কের জন্য বিখ্যাত। এটি প্রতিরক্ষা খাতে, বিশেষ করে বর্মভেদী ক্ষেপণাস্ত্র তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। চীন এই খনিজ রপ্তানির উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে মার্কিন প্রতিরক্ষা খাতের উপর প্রভাব ফেলতে চায়।
আরও পড়ুন: China-Panama Rift: চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড প্রকল্প থেকে সরে দাঁড়াচ্ছে পানামা, প্রশংসা আমেরিকার
PVH ও Illumina-র বিরুদ্ধে চীনের অভিযোগ
PVH শুধু ক্যালভিন ক্লেইনের মালিকই নয়, বরং টমি হিলফিগারেরও মূল সংস্থা। এই কোম্পানির বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা জিনজিয়াং অঞ্চলের তুলো বর্জন করেছে, যদিও চীনের বিবৃতিতে এই বিষয়টি উল্লেখ করা হয়নি।
Illumina বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ জিন সিকোয়েন্সিং সংস্থা, যা চীনের BGI Genomics-এর প্রতিদ্বন্দ্বী। চীন এই মার্কিন সংস্থার বিরুদ্ধে তদন্ত চালাচ্ছে, যা বাণিজ্যযুদ্ধের একটি অংশ বলেই মনে করা হচ্ছে।
ট্রাম্পের নির্দেশ ও ভবিষ্যৎ বাণিজ্য সম্পর্ক
ট্রাম্প মঙ্গলবার মধ্যরাত থেকে চীনা রপ্তানির উপর শুল্ক কার্যকর করার নির্দেশ দেন। তার অভিযোগ, বেজিং অবৈধ মাদক পাচার রোধে ব্যর্থ হয়েছে। তিনি আরও নির্দেশ দিয়েছেন, যদি চীন পাল্টা প্রতিক্রিয়া দেখায়, তাহলে শুল্ক আরও বাড়ানো হবে।
কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চীন যদি আরও কঠোর প্রতিক্রিয়া দেখায়, তাহলে দুই দেশের সম্পর্ক আরও খারাপ হতে পারে। ২০২৩ সালের নভেম্বর মাসে শি জিনপিং ও তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সান ফ্রান্সিসকোতে বৈঠক করেছিলেন। এরপর থেকে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল ছিল। তবে, টেকনোলজি অ্যাক্সেস ও ভূখণ্ড সংক্রান্ত বিরোধ এখনও চলছে।
ট্রাম্প ও শি ইতিমধ্যেই ফোনে কথা বলেছেন, যেখানে বাণিজ্য, টিকটক ও ফেন্টানিল ইস্যু নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সোমবার ট্রাম্প বলেন, “আমার ধারণা, আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে শি-এর সঙ্গে আমার আবার কথা হবে।” কিন্তু বেজিং এখনও এই মন্তব্যের কোনও আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানায়নি।
অর্থনীতির জন্য বড় ধাক্কা?
চীন ও আমেরিকার এই নতুন বাণিজ্যযুদ্ধ বিশ্ব অর্থনীতির জন্য বড় ধাক্কা হতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যদি দুই দেশ আলোচনার মাধ্যমে সমাধানে না পৌঁছায়, তাহলে আরও কঠোর শুল্ক আরোপ হতে পারে। এই শুল্কের প্রভাব শুধু চীন ও আমেরিকার উপরই নয়, বরং বিশ্বের অন্যান্য দেশ, বিশেষ করে এশিয়া ও ইউরোপেও পড়বে।