ট্রাইব টিভি বাংলা ডিজিটাল: ভারতীয় সেনাবাহিনী (INDIAN ARMY) স্বাধীনতার পর থেকে একাধিক সাহসী সামরিক অভিযান চালিয়েছে(Military Operation)। এই অভিযানগুলো কেবল দেশের ভৌগোলিক অখণ্ডতাই রক্ষা করেনি, বরং ভারতের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তিও উজ্জ্বল করেছে। এখানে ১০টি ঐতিহাসিক অপারেশন নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হল।
১. অপারেশন রক্ষণ (১৯৪৭-৪৮) (Military Operation)
সময়কাল: অক্টোবর ১৯৪৭ – জানুয়ারি ১৯৪৯
পরিস্থিতি: স্বাধীনতার পরপরই জম্মু ও কাশ্মীরে পাকিস্তান-সমর্থিত উপজাতি বাহিনী প্রবেশ করে। মহারাজা হরি সিং ভারতের কাছে সাহায্য চাইলে ভারতীয় সেনা অপারেশন রক্ষণ শুরু করে।
ফলাফল: ভারতীয় সেনা শ্রীনগর বিমানবন্দর দখল করে এবং অনুপ্রবেশকারীদের অনেকাংশকে পিছু হটাতে বাধ্য করে। এর ফলেই জম্মু-কাশ্মীর ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়।
কৌশলগত গুরুত্ব: কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করা এবং পাকিস্তানের প্রথম দখল প্রচেষ্টা ব্যর্থ করা।
২. অপারেশন জ্যাকপট (১৯৭১ – বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ) (Military Operation)
সময়কাল: ডিসেম্বর ১৯৭১
পরিস্থিতি: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সরাসরি সামরিক হস্তক্ষেপ করে। ভারতীয় নৌবাহিনী চালায় অপারেশন জ্যাকপট, যেখানে চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দরে পাকিস্তানি জাহাজ ধ্বংস করা হয়।
ফলাফল: নৌযুদ্ধে পাকিস্তানি নৌবাহিনী গুরুতর ক্ষতির সম্মুখীন হয় এবং মুক্তিযুদ্ধের জয় দ্রুততর হয়।
কৌশলগত গুরুত্ব: বাংলাদেশকে মুক্ত করতে এবং পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানি সেনার যোগান বন্ধ করতে সাহায্য করে।

৩. অপারেশন মেঘদূত (১৯৮৪) (Military Operation)
সময়কাল: এপ্রিল ১৯৮৪ – চলমান
পরিস্থিতি: সিয়াচেন গ্লেসিয়ারের কৌশলগত দখল নিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়। ভারতীয় সেনা হেলিকপ্টার ও ট্রেকিং ব্যবহার করে দ্রুত গ্লেসিয়ারে পৌঁছে যায়।
ফলাফল: ভারত সিয়াচেন গ্লেসিয়ারের মূল পয়েন্ট দখল করে এবং আজও নিয়ন্ত্রণ ধরে রেখেছে।
কৌশলগত গুরুত্ব: বিশ্বের সর্বোচ্চ যুদ্ধক্ষেত্রে কৌশলগত আধিপত্য স্থাপন।

৪. অপারেশন ব্লু স্টার (১৯৮৪) (Military Operation)
সময়কাল: ৩ – ৬ জুন ১৯৮৪
পরিস্থিতি: পাঞ্জাবের অমৃতসরের স্বর্ণমন্দিরে সশস্ত্র জঙ্গি নেতা জর্ণাইল সিং ভিন্দ্রানওয়ালে এবং তার অনুসারীরা আশ্রয় নিয়েছিল।
ফলাফল: সেনা অভিযান সফল হলেও বহু হতাহতের ঘটনা ঘটে এবং এটি রাজনৈতিকভাবে বিতর্কিত হয়।
কৌশলগত গুরুত্ব: পাঞ্জাবে সন্ত্রাসবাদ দমন এবং গুরত্বপূর্ণ ধর্মীয় স্থানে আইন-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা।

৫. অপারেশন চেকমেট (১৯৮৭) (Military Operation)
সময়কাল: ১৯৮৭-১৯৯০
পরিস্থিতি: শ্রীলঙ্কার গৃহযুদ্ধের সময় ভারতীয় শান্তিরক্ষী বাহিনী (IPKF) তামিল টাইগারদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে অভিযান চালায়।
ফলাফল: তীব্র সংঘর্ষের পর LTTE দুর্বল হয়ে পড়ে।
কৌশলগত গুরুত্ব: ভারতীয় ভূরাজনৈতিক প্রভাব বজায় রাখা এবং দক্ষিণ এশিয়ায় স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা।
আরও পড়ুন: Top 5 Special Force : বিশ্বের সবচেয়ে দক্ষ ৫টি স্পেশাল মিলিটারি ফোর্স!
৬. অপারেশন ক্যাকটাস (১৯৮৮) (Military Operation)
সময়কাল: নভেম্বর ১৯৮৮
পরিস্থিতি: মালদ্বীপে একদল বিদ্রোহী অভ্যুত্থান ঘটানোর চেষ্টা করে। মালদ্বীপ সরকার ভারতের কাছে সাহায্য চায়।
ফলাফল: ভারতীয় সেনা দ্রুত বিমানযোগে পৌঁছে বিদ্রোহ দমন করে এবং সরকারকে রক্ষা করে।
কৌশলগত গুরুত্ব: ভারতীয় সেনার দ্রুত প্রতিক্রিয়া দেওয়ার সক্ষমতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
৭. অপারেশন বিজয় (১৯৯৯ – কারগিল যুদ্ধ) (Military Operation)
সময়কাল: মে – জুলাই ১৯৯৯
পরিস্থিতি: পাকিস্তানি সেনারা গোপনে কারগিল অঞ্চলে প্রবেশ করে এবং কৌশলগত পোস্ট দখল করে।
ফলাফল: ভারতীয় সেনা প্রবল প্রতিরোধ ও পাহাড়ি যুদ্ধ কৌশল ব্যবহার করে পাকিস্তানি অনুপ্রবেশকারীদের হটিয়ে দেয়।
কৌশলগত গুরুত্ব: ভারতীয় সেনার পাহাড়ি যুদ্ধ দক্ষতার প্রমাণ এবং দেশের ভৌগোলিক অখণ্ডতা রক্ষা।

৮. অপারেশন পারাক্রম (২০০১-২০০২)
সময়কাল: ডিসেম্বর ২০০১ – অক্টোবর ২০০২
পরিস্থিতি: সংসদ হামলার পর ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে উত্তেজনা তৈরি হয়। ভারতীয় সেনা সীমান্তে ব্যাপক সৈন্য সমাবেশ করে।
ফলাফল: পাকিস্তানের উপর কূটনৈতিক ও সামরিক চাপ তৈরি হয় এবং জঙ্গি কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণে আসে।
কৌশলগত গুরুত্ব: ভারতীয় সেনার কৌশলগত শক্তি প্রদর্শন এবং সন্ত্রাসবাদ বিরোধী বার্তা দেওয়া।
৯. সার্জিক্যাল স্ট্রাইক (২০১৬)
সময়কাল: ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৬
পরিস্থিতি: উরির সেনা শিবিরে পাকিস্তানি জঙ্গি হামলার পর ভারত সীমান্তের ওপারে প্রবেশ করে জঙ্গি ক্যাম্প ধ্বংস করে।
ফলাফল: একাধিক জঙ্গি ঘাঁটি ধ্বংস এবং বিপুল সন্ত্রাসী হতাহত।
কৌশলগত গুরুত্ব: ভারতীয় সেনার ‘নো টলারেন্স’ নীতি ও আক্রমণাত্মক প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন।
১০. অপারেশন শক্তি (১৯৯৮ – পোখরান-II)(Military Operation)
সময়কাল: মে ১৯৯৮
পরিস্থিতি: ভারতীয় সেনা ও বৈজ্ঞানিক দলের যৌথ উদ্যোগে গোপনে ৫টি পরমাণু পরীক্ষা চালানো হয়।
ফলাফল: ভারত পরমাণু শক্তিধর দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
কৌশলগত গুরুত্ব: ভারতের প্রতিরক্ষা সক্ষমতা ও আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক অবস্থান শক্তিশালী করা।
অপারেশনগুলোর কৌশলগত গুরুত্ব
এই অপারেশনগুলো ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা নীতি, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। কারগিল যুদ্ধ বা সার্জিক্যাল স্ট্রাইক ভারতের সীমান্ত নিরাপত্তার বার্তা দেয়, আবার অপারেশন ক্যাকটাস বা মেঘদূত আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক শক্তির ভারসাম্যে ভারতের নেতৃত্বের ক্ষমতা তুলে ধরে।
ভারতীয় সেনার ইতিহাসে এই ১০টি অভিযান কেবল সামরিক সাফল্যের কাহিনী নয়, বরং দেশের অদম্য সাহস, প্রযুক্তিগত উন্নয়ন এবং কৌশলগত দক্ষতার প্রতীক। প্রতিটি অভিযান প্রমাণ করে দিয়েছে যে ভারতীয় সেনা শুধু প্রতিরক্ষা নয়, আক্রমণাত্মক ও দ্রুত প্রতিক্রিয়া দেওয়ার ক্ষমতাতেও বিশ্বমানের।