ইন্ডিয়া টুডে ফ্যাক্ট চেক: আর্থিকভাবে অসচ্ছ্বল কোনও পরিবারের সদস্যরা (Fact Check) কঠিক রোগ-ব্যাধির কবলে পড়লে অনেক সময়ই সোশ্যাল মিডিয়ায় সাহায্যের হাত পেতে দিতে দেখা যায় নানা ফেসবুক ব্যবহারকারীদের। রোগীর ছবি দেখে, রোগের বর্ণনা শুনে অনেক সময়ই অনেকে টাকাও দেন। কিন্তু এই মানবিক ঘটনাক্রম ক্রমশ বিপজ্জনক মোড় নিতে শুরু করেছে।
সম্প্রতি এমন বহু পোস্ট ফেসবুকে (Fact Check) দেখা যাচ্ছে। যেখানে কঠিন রোগে আক্রান্ত এক শিশুর ও তার বাবা-মায়ের ছবি পোস্ট করা হচ্ছে। সঙ্গে থাকছে একটি গল্প যা শুনলে নরম মনের মানুষ গলে জল হয়ে যাবে। গল্পর ধরন খানিকটা এরকম যে-এই শিশুটি কঠিন ও মারণ কোনও রোগে আক্রান্ত। তার বাবা মা দু’জনেই আর্থিকভাবে সচ্ছ্বল নয়। কিন্তু চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন যে শিশুটিকে সারিয়ে তুলতে কয়েক লক্ষ টাকা প্রয়োজন।
সেই পোস্টের সঙ্গে শিশুটির ও বাবা মায়ের নাম দেওয়া (Fact Check) থাকছে। সঙ্গে থাকছে বিকাশ (বাংলাদেশের ডিজিটাল পেমেন্ট সিস্টেম) নম্বর। ঠিক যেমন সম্প্রতি একটি পোস্ট ভাইরাল হয়েছে যেখানে একইভাবে কয়েকটি ছবি শেয়ার করে বলা হচ্ছে যে, রোগাক্রান্ত শিশুটির নাম জান্নাতুন সাফরা। সে বাংলাদেশের রংপুরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রয়েছে এবং চিকিৎসার জন্য কয়েক লক্ষ টাকা প্রয়োজন। সেই সঙ্গে বিকাশ ওয়ালেটের নম্বর দেওয়া হয়েছে।

আরেকটি শিশু যার মাথার বাঁ-দিকে একটি কঠিন রোগ দানা (Fact Check) বেঁধেছে তার ছবিও শেয়ার করে একই ধরনের দাবি করা হচ্ছে। আলাদা-আলাদা বিভিন্ন প্রোফাইল থেকে ছবিগুলি পোস্ট করে বলা হচ্ছে এই শিশুটি তার ছেলে। উভয় ক্ষেত্রেই আলাদা আলাদা বিকাশ ওয়ালেটের নম্বর দেওয়া হয়েছে।

এ তো না হয় গেল বাংলাদেশের কথা। ভারতেও, বিশেষ করে (Fact Check) পশ্চিমবঙ্গের নেটাগরিকদের মধ্যে আরেকটি পোস্ট ভাইরাল হচ্ছে। যেখানে একটি ছোট্ট মেয়েকে হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে। বাদ বাকি ছবিগুলির একটি এক ব্যক্তিকে কাঁদতে দেখা যাচ্ছে। সেই সঙ্গে কিউআর কোড স্ক্যানারও দেওয়া হয়েছে। কিন্তু পেমেন্ট করার জন্য কোনও ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট ডিটেলস বা যোগাযোগের কোনও ফোন নম্বর নেই।
এই ছবিগুলি শেয়ার করে কেউ লিখছেন যে অসুস্থ (Fact Check) মেয়েটির নাম অঞ্জলি সরকার, কেউ আবার লিখছেন যে মেয়েটির নাম অঞ্জলি শব্দকর এবং মেয়েটি নদীয়ার বাসিন্দা।

এই সকল পোস্টগুলির মধ্যে যে মূল বিষয়টি প্রধান, তা হলো- প্রতিটি ক্যাপশন (Fact Check) শুরুই হচ্ছে “ভিক্ষুকের মত নির্লজ্জ ভাবে পায়ে ধরে শুধুই….” কথার মাধ্যমে।
আজতক ফ্যাক্ট চেকের পক্ষ থেকে বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘ অনুসন্ধানের (Fact Check) মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়া গিয়েছে যে এই ছবিগুলি নানা ধরনের ক্রাউডফান্ডিং ওয়েবসাইট থেকে সংগ্রহ করে সম্পূর্ণ অন্য গল্প বানিয়ে প্রতারণার কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে।
প্রতারণার জাল ছড়াচ্ছে যেভাবে (Fact Check)
প্রথম ছবি, যেখানে অসুস্থ শিশুটিকে জান্নাতুন সাফরা বলা হচ্ছে, সেই ছবিটি রিভার্স ইমেজ সার্চের মাধ্যমে খোঁজা হলে আসল ছবিগুলি ফান্ডরেইসার ওয়েবসাইট Ketto-তে পাওয়া যায়। সেখান থেকে জানা যায়, এই শিশুটির নাম মারিয়াম এবং ১২ বছর বয়সে সে অস্থি বা হাড়ের ক্যানসারে আক্রান্ত হয়েছিল।

তার মা খাতিজা এই ফান্ডরেইসার ক্যাম্পেইনটি (Fact Check) শুরু করেন। কিন্তু বছর দুয়েক আগেকার শেষ আপডেট অনুযায়ী, মুম্বইয়ের এক হাসপাতালে মারিয়াম মারা যায়। সকল সাহায্যার্থীদের চেষ্টা সত্ত্বেও তার প্রাণ বাঁচানো সম্ভব হয়নি। এর থেকেই পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে যে কীভাবে ভারতীয় শিশু মারিয়াম, যার দুবছর আগে মৃত্যু হয়েছে, তার ছবি ছড়িয়ে জালিয়াতি করা হচ্ছে।
আরও পড়ুন: Fact Check: বিশালাকার এই পাথরের সঙ্গে ইজিপ্টে তৈরি পিরামিডের কোনও সম্পর্ক নেই

এই ছবিটিকে রিভার্স ইমেজ সার্চের সাহায্যে খোঁজা হলে ওই ছবিগুলিও Ketto-র ওয়েবসাইটে মেলে। সেখান থেকে জানা যায়, এই শিশুকন্যাটির নাম তাজরিন। তাজরিনের বাবা মহম্মদ জসিম জানান, তাজরিনের চোখে একটি ছোট ফোস্কার থেকে ধীরে-ধীরে তা একটি বিরল ক্যানসারের রূপ নেয়। তখনই তাজরিনের প্রাণ রক্ষা করতে জসিম এই উদ্যোগ দেন।

এই ক্যাম্পেইনের শেষ এসেছিল চার বছর আগে। সেই আপডেট অনুযায়ী, তাজরি এখন পুরোপুরি সুস্থ এবং কিমোথেরাপি শেষ হলে সে স্কুলে যেতেও তৈরি হয়ে যাবে এবং সে নিজের বাংলাদেশের বাড়ি ফিরে গিয়েছে।
জালিয়াতির জাল পশ্চিমবঙ্গেও
তৃতীয় পোস্টের এই সূত্র ধরে সার্চ করতেই আমরা দেখতে পাই অঞ্জলি সরকার ও অঞ্জলি শব্দকর এই দুটি নামে ওই আরেকটি শিশুকন্যার যে ছবি শেয়ার হচ্ছে, তা আসলে Impact Guru-র ভ্যারিফায়েড ফেসবুক পেজে রয়েছে।
গত ১৪ জানুয়ারি ফেসবুক পেজে ছবিগুলো পোস্ট করে ক্যাপশনে লেখা হয়, “আমার ৬ বছরের মেয়ে শ্রীজা, একটি মর্মান্তিক দুর্ঘটনার পরে আইসিইউতে তার জীবনের জন্য লড়ছে। ১৩টি অস্ত্রোপচার করা সত্ত্বেও তার অবস্থা এখনও গুরুতর, এবং সে আর কোনওদিন স্বাভাবিকভাবে মল ত্যাগ করতে পারবে না। সীমিত আয় এবং শেষ হয়ে যাওয়া সঞ্চয় নিয়ে আমরা চিকিৎসার খরচ টানতে হিমশিম খাচ্ছি। ওর জীবন বাঁচানোর জন্য আপনাদের সাহায্য প্রয়োজন। যে কোনও সাহায্য, বড় হোক বা ছোট, শ্রীজাকে বাঁচার সুযোগ করে দেওয়ার কাছাকাছি নিয়ে যাবে।”
শ্রীজার দুর্ঘটনা এবং চিকিৎসা নিয়ে বিস্তারিত তথ্য Impact Guru-র ওয়েবসাইট থেকে জানা যায়। সেখানেই উল্লেখ পায়, বছর ৬-এর শ্রীজা বর্তমানে কলকাতার অ্যাপোলো হাসপাতালে আইসিইউ বিভাগে ভর্তি। শ্রীজার বাবা সুভাষ মিত্র এই ক্যাম্পেন শুরু করেন। শ্রীজার মায়ের তরফ থেকে লেখা হয়, ২০২৪ সালের ২৮ অক্টোবর তাদের পরিবার একটি দুর্ঘটনার কবলে পড়ে যখন একটি ট্রাক এসে ধাক্কা মারে। দুর্ঘটনার শ্রীজার শরীরের নীচের অংশের হাড় সম্পূর্ণভাবে ভেঙে যায়। ইতিমধ্যেই তার ১৩টি অস্ত্রপচার হয়ে গিয়েছে এবং চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন সে আর কোনও দিন স্বাভাবিকভাবে মলত্যাগ করতে পারবে না।
অন্যদিকে যে দুটি কিউআর কোড এই পোস্টগুলির সঙ্গে শেয়ার করা হয়েছে, তার একটি অ্যাকাউন্ট সঞ্জীব শব্দকর, এবং অপর অ্যাকাউন্টটি Meen Bist নামে রেজিস্টার করা হয়েছে। দুটি কোডের ইউপিআই আইডি যথাক্রমে xxxxxxaxisjoining@axis এবং c.sarkar@freecharge. বলাই বাহুল্য, উভয় আইডি থেকেই শ্রীজার ছবি ব্যবহার করে জালিয়াতির ফাঁদ পাতা হয়েছে।
কারণ একই কিউআর কোড এবং নাম ব্যবহার করে আগেও জালিয়াতির ফাঁদ পাতা হয়েছিল। নীচে রইল সেই স্ক্রিনশট।

শুধু তাই নয়, জালিয়াতরা অ্যাপোলো হাসপাতালের নথিও জাল করে সেখানে শ্রীজা মিত্রের নাম বদলে তা এডিট করে অঞ্জলি সরকার করে দিয়েছে। নীচে আসল নথি দেওয়া হলো যা Impact Guru-র ওয়েবসাইটেও রয়েছে।

বাংলাদেশের বিকাশ ওয়ালেটে যুক্ত নম্বরগুলিতে হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে যোগাযোগ করা হলেও সেখান থেকে কোনও উত্তর আসেনি। ফোন করা হলে তা তোলা হয়নি। এর মধ্যে কয়েকটি নম্বর তা ফ্রড বা প্রতারণার উদ্দেশ্যে তৈরি তা ট্রু কলারে সার্চ করে ইঙ্গিত পাওয়া যায়।

এই বিষয়ে আমরা আমরা ফান্ডরেইজিং ওয়েবসাইট কিটো এবং ইমপ্যাক্টগুরু কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। তাদের তরফ থেকে উত্তর এলে রিপোর্টটি আপডেট করে দেওয়া হবে। পাশাপাশি এই ধরনের নতুন কোনও জালিয়াতি আমাদের নজরে এলে সেই বিষয়টিও আপডেট করে দেওয়া হবে। তাই ফেসবুকে কোনও পোস্ট দেখে টাকা দেওয়া, বা শেয়ার করার আগে তা ভালোভাবে যাচাই করে নেওয়াই কাম্য।
এই খবরটি শক্তি কালেক্টিভের অংশ হিসাবে প্রথমে ইন্ডিয়া টুডে দ্বারা প্রকাশিত হয়েছিল, পরবর্তীতে ট্রাইব টিভি বাংলার দ্বারা প্রকাশিত হয়েছে। এই খবরটির সারসংক্ষেপ বাদে বাকি খবর ট্রাইব টিভি বাংলার কর্মীরা সম্পাদনা করেনি।