সোমনাথ ঘোষ, হুগলি: ঠিক কতদিন আগে এই পুজোর সূচনা হয়েছিল তা জানা না গেলেও হালদারদের বর্তমান প্রজন্মের অনুমান চারশ বছরের বেশি সময় আগে এই পুজো শুরু হয়। পুজোর সূচনায় রয়েছে চমক প্রদ কাহিনী। এক সময় চুঁচুড়া ষন্ডেশ্বরতলার উত্তর দিকে গঙ্গার তীরে শ্মশান ছিল। সেখানেই পর্ণ কুটিরে বসবাস করতেন এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ। নদী পথে যাওয়ার সময় অনেকেই আসতেন ব্রাহ্মণের কুটিরে আশ্রয় নিতে। একদিন ঝড় বৃষ্টির রাতে এক বৃহন্নলা আসেন আশ্রয় নিতে। তাকে কুটিরে আশ্রয় দিয়ে নিজে শ্মশানে ঘুমিয়ে পরেন ব্রাহ্মণ।
সকালে উঠে দেখেন সেই বৃহন্নলা আর নেই। তার বদলে সেখানে রয়েছে মোহর ভর্তি কলস। এদিক ওদিক খুঁজে কাউকে না পেয়ে গঙ্গা স্নান সেরে ক্লান্ত হয়ে কুটিরে ঘুমিয়ে পরেন। স্বপ্নে মা দুর্গার দৈববাণী পান। মন্দির স্থাপন করে সেখানে পুজো করার। সেই মত দুর্গামণ্ডপ স্থাপন করে পুজোর সূচনা হয়। ব্রাহ্মণের কোনও পরিচয় পাওয়া না গেলেও জানা যায় সেই মোহর দিয়ে দুর্গা দালান সহ প্রাসাদ গড়ে ওঠে। সেই প্রাসাদে বসবাস করতে থাকেন পাঠক বংশীয় সেবাইতরা। সেই থেকেই জায়গার নাম হয় পাঠক গলি। গঙ্গা ঘাটের নাম হয় পাঠক ঘাট। দুর্গা দালান সহ বাড়ি দেবোত্তর সম্পত্তি হিসাবে থেকে যায়।
আরও পড়ুন: https://tribetv.in/300-years-old-durga-puja-history-of-mandals/
হালদার বংশের পুরুষ মাধব হালদারের একমাত্র পুত্র নবীন চন্দ্র হালদারের সঙ্গে পাঠক বংশের বংশধর বৃন্দাবন পাঠকের একমাত্র কন্যা কুসুম কুমারীর বিবাহ হয়। উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে। কুসুম কুমারী পাঠকদের উত্তরাধিকার ছিলেন তাই দুর্গা পুজোরও উত্তরাধিকার প্রাপ্ত হন। পাঠকদের পুজো হালদারদের কাছে চলে আসে। নবীন চন্দ্র ও কুসুম কুমারীর পুত্র সত্যচরন পুত্রবধূ সুহাসিনী দেবী নিষ্ঠার সঙ্গে বাসুদেব জিউ ও দুর্গার পুজো করতে থাকেন।
রথের দিন উৎসব হয় হালদার বাড়িতে। সেদিনই হয় কাঠামো পুজো। এরপরই শুরু হয় ঠাকুর গড়া। আগে কৃষ্ণনগর থেকে কুমোর আসত। এখন স্থানীয় কুমোরই প্রতিমা তৈরী করেন। মহালয়ার পিতৃতর্পণের পর প্রতিপদে দেবীর ঘট বসে। দালানে কুটির ঘরে ষষ্ঠীর দিন বোধন বসে সন্ধেবেলায়। সপ্তমীর দিন সকালে কলা বউ স্নানের মধ্যে দিয়ে শুরু হয় পুজো। আরতি পুষ্পাঞ্জলি, ভোগ, আরতি, চন্ডীপাঠ চলে। অষ্টমীর দিন ধুনো পোড়ানো হয়। নবমীর সকালে কুমারী পুজো হয়। পুজো হয় বৈষ্ণব মতে। দশমীর দিন অপরাজিতা ধারণ হালদার বাড়ির পুজোর একটা বৈশিষ্ট্য। অপরাজিতা ধারণ করে ষন্ডেশ্বর মন্দিরে গিয়ে পুজো ও প্রদক্ষিণ করে বাড়ি ফিরে আসেন সকলে। যতক্ষন না বিসর্জন হয় ততক্ষন হালদার বাড়িতে উনুন ধরে না।
আরও পড়ুন: https://tribetv.in/bangladeshi-artists-are-working-in-durga-puja-mandap-in-west-bengal/
হালদার বাড়ির পুজোয় নয়দিন ধরে নিরামিষ খাওয়া হয়। তাতে শুক্তো থাকে রোজ। বরি দিয়ে তেঁতুলের টকও থাকে। রাঁধুনী আজও আসে সেই উড়িষ্যার বালেশ্বর থেকে। হালদার বাড়ির শুক্তো নাকি মুখে লেগে থাকে, এরকমই তার স্বাদ। পরিবারের সবার জন্য তো বটেই বাইরে থেকে যারা আসেন সবার জন্য পাত পরে পুজোর কটা দিন। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয় পুজোর দালানের সামনে।
এক সময় প্রতিমা নৌকায় তুলে নদী পরিক্রমার পর বিসর্জন হত। একবার দুর্ঘটনার পর সেই প্রথা বন্ধ হয়। এখন পাঠক ঘাটে বিসর্জন করে কাঠামো তুলে আনা হয়। বিজয়ের প্রণাম কোলাকুলি চলে। নয় দিনের নিরামিষ খাওয়া শেষ হয়। দশমীতে হয় মৎস মুখ।